বছরের পর বছর ধরে খেলাপি ঋণের হাজার হাজার মামলা অর্থঋণ আদালতগুলোতে ঝুলে রয়েছে। ওসব মামলা নিষ্পত্তি হলে আদায় হতো বিপুল টাকা। বর্তমানে ঝুলে থাকা খেলাপি ঋণের মামলার সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। আর চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তাছাড়া এটি গত ১৬ বছরের মধ্যে বিতরণ করা ঋণ ও খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ অনুপাত। গত বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। আর গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, যা ৩০ মার্চ পর্যন্ত ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। আদালত ও ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারা দেশের অর্থঋণ আদালতে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ২০ হাজার ৫৯৩টি মামলা বিচারাধীন ছিলো। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলছে ৩ হাজার ২৬৯টি মামলা। আর ৪২টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। ওসব মামলার মধ্যে শুধু ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতেই ৮ হাজার ৫৭৮টি খেলাপি ঋণের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হওয়ায় বিপদে পড়ছেন ঋণগ্রহীতারা। আবার ব্যাংকগুলোও আদায় করতে পারছে না ঋণের টাকা। সূত্র জানায়, দেশে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় কম। তাছাড়া আদালতগুলোর বিচারকসংখ্যাও যথেষ্ট নয়। নানা কারণে অর্থঋণ আদালতের মামলাজট তৈরি হচ্ছে। আর খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়রানিও বাড়ছে। মামলা ঝুলে থাকায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহকরাও। মূলত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষই অনীহা দেখায়। কোনো মামলায় বাদী আগ্রহী হলে বিবাদীর অনাগ্রহ থাকে। আবার কোনোটিতে বিবাদী মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি চাইলে বাদী সময় আবেদন করে কালক্ষেপণ করে। ফলে মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকছে। সূত্র আরো জানায়, দেশে ঋণখেলাপির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ দেশের অভ্যন্তরেও নানা চাপ রয়েছে। কিন্তু নানা চেষ্টা করেও তা কমানো যাচ্ছে না। আর অর্থঋণ আদালতে মামলার দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে অনেক গ্রাহক ইচ্ছাকৃত খেলাপি বনে যাচ্ছে। ফলে লাগামছাড়া হয়ে পড়েছে খেলাপি। খেলাপি কমাতে আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ছাড়া বিকল্প নেই। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক তৃতীয় পক্ষ হিসেবে খেলাপি ঋণের প্রায় সব মামলাতেই পার্টি থাকেন। সরাসরি তাদের দায় না থাকলেও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের অনেক দায়। খেলাপি ঋণের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গুরুত্ব সহকারে এগিয়ে আসা জরুরি। এদিকে ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের মতে, যখন ব্যাংকগুলো বুঝতে পারে যে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আর খেলাপি ঋণ আদায় করা যাবে না, চূড়ান্ত ব্যবস্থা হিসেবে তারা মামলায় যায়। দেশে এই মামলার একমাত্র আদালত হচ্ছে অর্থ ঋণ আদালত। ক্রেডিট কার্ড খেলাপি থেকে শুরু করে ছোট বড় কোটি কোটি টাকার ঋণখেলাপির সব মামলায় সব ব্যাংককে এই একটা আদালতেই যেতে হয়। যখন ঋণ আদায়ের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়, আশা থাকে না, তখন সেটাকে রাইট-অফ করার জন্যও মামলা করতে হয়। ওই কারণে সেখানে মামলার সংখ্যা অনেক বেশি। অন্যদিকে এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন জানান, পর্যাপ্ত সংখ্যক আদালত ও বিচারক সংকটের কারণে অর্থঋণের মামলাগুলো দীর্ঘদিন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। খেলাপিদের বিরুদ্ধে দেশের আইনি কাঠামো অন্যান্য দেশের মতো শক্তিশালী নয়। যা আছে ওই আইনি প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রভাবশালী শক্তি সক্রিয়।