জন্মকালীন অসহায়ত্ব কাটাতে মানব সন্তানকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় অন্যের নিবিড় তত্ত্বাবধানে। এই পরনির্ভরশীলতার মাঝে মানব শিশুর অভিযোজন ঘটে পরিবেশের সাথে, তৈরি হয় বন্ধন। জন্ম পরবর্তী এ বন্ধন বাবা-মার হাত ধরে মিলন ঘটায় সমাজের সাথে। তাই পিতা-মাতাই শিশুর প্রথম ও বুনিয়াদি শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে পিতা-মাতার এ সময়ের শিক্ষা, শিশুর পরবর্তী সারা জীবনকেই প্রভাবিত করে। এটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কের সূচনা পর্ব। শৈশবকালে বাবা-মার সামান্যতম অবহেলা শিশুর চলার ছান্দিক স্বকীয়তা ও শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত করতে পারে।
‘পিতামাতার অন্যপ্রান্তে বিদ্যালয় আর বিদ্যালয়ের অন্যপ্রান্তে বাড়ি’- এই হলো শিশুর ঠিকানা। এ পর্যায়টি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রিক এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক পর্ব। শিশুরা এ সময় জ্ঞানার্জনের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক বলতে মূলত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কালকেই বিবেচনায় নেয়া হয়; যা প্রাথমিক হতে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত বিস্তৃত।
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা কাদামাটির মতো। এ স্তরের শিক্ষক কুমারের মতো যেমন খুশি শিক্ষার্থীকে গড়ে তুলতে পারেন। এ স্তরের শিক্ষা হলো উচ্চ শিক্ষা বা জাতীয় উন্নয়নের ভিত্তি ভুমি। ফ্রেয়বেল এঁর মতে, শিক্ষকের কাজ ফুল বাগানের মালির মতো। ফুলের চারা লালন পালন করে ফুলফল ধরানোই হলো শিক্ষকের কাজ। একজন শিক্ষক একটি শিশুর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানলাভের দরোজা স্বরূপ। শিশুর ভেতরে সৃষ্টিশীলতা জাগ্রত করতে শিক্ষককে অনুসরণীয় মডেল হিসেবে আবির্ভূত হতে হয়। এ পি জে আবুল কালাম এঁর মতে, ‘বাবা, মা ও শিক্ষক এই তিনজনই একটি শিশুর ত্রি-মত্রিক রোল মোডেল’।
মাধ্যমিক স্তর শিক্ষার্থীকে আত্মদর্শনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার ধারনা হতে নিজেকে জানার সুযোগ করে দেয়। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষক শিল্পীর ন্যায় শিক্ষার্থীর মনের সহজাত প্রবৃত্তি, ধী-মনীষা ও সুপ্ত সম্ভাবনার পরিস্ফুটন ঘটিয়ে সত্যিকারের মানুষ তৈরির কাজে নিয়োজিত থাকেন। এ সময় শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞান পিপাসা ও স্বপ্ন সৃষ্টিই শিক্ষকের মূল কাজ। আনুষ্ঠানিক এ শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে দাতা ও গ্রহিতার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। রসায়নের ভাষায়, দাতা ও গ্রহিতা মৌলের সমান আসক্তির ফলেই আয়নিক বন্ধন গঠিত হয়। অর্থাৎ শিক্ষকের জানানোর আগ্রহ এবং শিক্ষার্থীর জানার আসক্তি প্রবল না হলে শিখন-শিখানো প্রক্রিয়া যথাযথ হয় না।
অন্যভাবে বলতে গেলে শিক্ষক হলো প্রবাহমান নদীর মতো। স্রােতস্বিনী যেভাবে ময়লা-জঞ্জাল ধুয়ে পুতপবিত্র করে তোলে এবং নিজ প্রবাহ গুণে অচল বস্তুকেও গতিশীল করতে পারে একজন শিক্ষকও ঠিক তাই। শিক্ষক তাঁর জ্ঞানের দ্বীপ্তি ছড়িয়ে শিক্ষার্থীর মনের অন্ধকার বিদূরিত করে শিক্ষার্থীকে উজ্জীবিত করে তোলে সত্য ও ন্যায়ের পথে। অন্যের অক্ষমতাকে অনায়াসেই সক্ষম করে তোলেন তিনি, এখানেই একজন শিক্ষকের সফলতা ও নিজস্বতা।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে এক অজানা অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়, যা আত্মীক ও পবিত্র। সুগভীর এ সম্পর্ক জাগতিক কোন কিছুর সাথে তুলনীয় নয়। এখানেই শিক্ষক মহান, যাঁকে কেউ স্পর্শ করতে পারে না। এ আসন শুধুই শিক্ষকের যা বেস্টিত থাকে আত্মমর্যাদা ও আত্মতৃপ্তির অদৃশ্য ছোঁয়ায়। একজন সুশিক্ষকের সম্পর্ক শিক্ষার্থীর পরিবারকেও আকর্ষিত করে, ফলে পরিবারের লোকজনও তাঁকে সম্মানের চোখে দেখেন। হেনরী এডাস এঁর মতে, ‘শিক্ষকের প্রভাব অনন্ত কালে গিয়েও শেষ হয় না’। অর্থাৎ একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীর মনোরাজ্যের এমন একটি স্থান দখল করে রাখেন যা শিক্ষার্থীকে জীবনের অন্তিম ক্ষণেও স্মরণ করাতে বাধ্য করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাকিস্তানী পদার্থ বিজ্ঞানী ড. আবদুস সালাম নোবেল প্রাইজ বিজয়ের পর লাহোর থেকে কোলকাতায় এসে তাঁর শিক্ষাগুরু শ্রী অনিলেন্দু গাঙ্গুলীর সাথে দেখা করে মুমূর্ষু শ্রী গাঙ্গুলীকে বলেছিলেন, ‘এই পদকের ওপর আমার চেয়ে আপনার অধিকার বেশি, আপনি আমাকে অঙ্ক ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন’। শিক্ষক তাঁর অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর হৃদয়ে যে আলোর মশাল জ্বালিয়ে দেন তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রজ্বলিত থাকে। এ অদৃশ্য আলোর অস্পর্শী দীপশিখা শিক্ষার্থীর অন্তরকে নাড়া দিতে থাকে সামনে থেকে আলোকবর্তিকার মতো। যে আলোয় শিক্ষার্থীরা স্পষ্টতই প্রভেদ করতে শেখে ন্যায়-অন্যায় আর সত্য-মিথ্যের যা খুব সহজেই খুঁজে পেতে সাহায্য করে কর্তব্যবোধ, মূল্যবোধ, সমাজবোধ ও দেশপ্রেম।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে গুরু-শিষ্য, অভিভাবক আবার কখনও বা বন্ধু। শিক্ষককে হতে হয় ন্যায়পরায়ণ, দয়ালু, মহৎ ও কর্তব্যপরায়ণ অর্থাৎ তিনি হবেন সুশিক্ষিত দেশপ্রেমের সীমাহীন আধার। একই সাথে শিক্ষার্থীদেরও বিনয়ী ও আনুগত্যশীলতার মতো গুণগুলো ধারণ করতে হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ককে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে জাতীয় উন্নয়নের সোপান হিসেবে দেখা উচিত। সঠিক শিক্ষা পেলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আত্মসম্মান ও নৈতিক মূল্যবোধের জন্ম হবে, যা আইন প্রয়োগ করে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক অনেক নিচে নেমে গেছে। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন শিক্ষালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মঝে যে সম্পর্ক জাতিকে দেখতে হলো তা রীতিমত উৎকন্ঠার। বিষয়গুলো নিয়ে গ্লাসনস্ত আলোচনা বেশ বিব্রতকরই বটে! শিক্ষার্থীরা আর শিক্ষকদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে চায় না। শিক্ষকও শিক্ষার্থীদের আগের মতো ভালবাসার উপকরণ খুঁজে পান না। উভয় পক্ষেরই বিশ্বাস ও আস্থার জায়গাটা যেন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। কোন অবস্থাতেই এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত করা সমীচীন নয়।
আগের দিনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের মতো। শিষ্য অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিয়ে শিক্ষককে সমীহ করতেন। শিক্ষকও সেই সমাদর অক্ষুন্ন রাখতে সামর্থের সর্বোচ্চটুকু উজাড় করে দিতে পিছপা হতেন না। শিক্ষক যদি ছাত্রদের আপন করতে না পারেন তাহলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক মধুর হয় না। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক মানানসই না হলে শিক্ষার বিনিময় যথাযথ হয় না। আমাদের শিক্ষালয়ে আবার সেই মনোরম সহায়ক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশ আনয়নে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের উন্নয়নের কোন বিকল্প থাকতে পারে না।
মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তার সন্তানকে। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের নিজ সন্তান তুল্য মনে করেন এবং শিক্ষার্থীর সমস্যা নিজের সমস্যা ভাবতে পারেন; একইভাবে শিক্ষার্থীরাও শিক্ষাগুরুকে পিতামাতার আসনে বসাতে পারেন তাহলে এ সমস্যা থাকার কথা নয়। প্রণিধানের বিষয় হলো- শিক্ষক ও বাবা-মা নিজেরাই বিচারক, তাঁদের বিচার তাঁদেরকেই করার সুযোগ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, তাঁদের বিচার করার ক্ষমতা রাষ্ট্র বা ধর্ম কোন বিবেচনাতেই সন্তানদের হাতে রাখা হয় নাই। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের এ মহেন্দ্রক্ষণে তাই সবার প্রত্যাশা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হোক স্নেহ, ভালোবাসা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ভক্তির সীমাহীন ডিবা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পবিত্র মধুর উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠুক আমাদের শিক্ষাঙ্গন; জাঁতি ফিরে পাক তার স্বপ্নের কারিগর।