সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে উচ্চপদগুলোতে অনুমোদিত পদের অতিরিক্ত জনবল নিয়োজিত থাকলেও নিম্ন পদগুলোতে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ রয়েছে। ওসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অনুমোদিত পদ সংখ্যার বিপরীতে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি দেয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
সর্বোচ্চ পদমর্যাদার কর্মকর্তারা গ্রেড-১ ভুক্ত আর সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের গ্রেড ২০। বিভিন্ন গ্রেডে ওসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদমর্যাদা অনুযায়ী বিভক্ত করা হয়। অনুমোদিত পদের চেয়ে এখন প্রায় ২২ শতাংশ বেশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ পাঁচ গ্রেডের জনবল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে গ্রেড-১-এ অনুমোদিত পদ ৯০টি রয়েছে। এর বিপরীতে নিয়োজিতের সংখ্যা ১০১ জন। অর্থাৎ অনুমোদনের অতিরিক্ত ১১ জন কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন।
আর গ্রেড-২-এর আওতায় অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১২৭টি হলেও ২৬৫ জন কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। ফলে গ্রেডটির আওতায় অনুমোদনের অতিরিক্ত ১৩৮ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। তৃতীয় গ্রেডে অনুমোদনের অতিরিক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা ১৪৮ (অনুমোদিত পদ ৩৭৬টি, নিয়োজিত আছেন ৫২৪ জন)। তাছাড়া চতুর্থ গ্রেডে অনুমোদিত ১৪১টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ১৫০ জন। পঞ্চম গ্রেডে অনুমোদিত পদ ১ হাজার ২৫টি বিপরীতে কর্মরত ১ হাজার ৯৯ জন। সূত্র জানায়, সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে দুজন অতিরিক্ত সচিব ও তিনজন যুগ্ম-সচিবের পদের অনুমোদন রয়েছে। তবে বর্তমানে সেখানে তিনজন অতিরিক্ত সচিব ও আটজন যুগ্ম সচিব কর্মরত। অর্থাৎ দুটি পদে পাঁচজন জনবলের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন অতিরিক্ত আরো ছয়জন কর্মকর্তা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী একজন অতিরিক্ত সচিব ও তিনজন যুগ্ম সচিবের পদের অনুমোদন রয়েছে। তবে বর্তমানে সেখানে তিনজন অতিরিক্ত সচিব ও সাতজন যুগ্ম-সচিব কর্মরত। অর্থাৎ দুটি পদে চারজন জনবলের বিপরীতে কর্মরত অতিরিক্ত আরো ছয়জন কর্মকর্তা। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী দপ্তরটিতে নেই কোনো অতিরিক্ত সচিবের পদ। তবে দপ্তরটিতে কর্মরত রয়েছেন দুজন অতিরিক্ত সচিব। সরকারে অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ পদগুলোয় অনুমোদনের অতিরিক্ত জনবল থাকলেও নিচের দিকের গ্রেডগুলোয় জনবলে ঘাটতি রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্রমেই বাড়ছে এ জনবলশূন্যতা।
সূত্র আরো জানায়, সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় ষষ্ঠ থেকে নবম গ্রেড পর্যন্ত বিদ্যমান পদের সংখ্যা মোট ৩ হাজার ৯২৪টি হলেও ওই চার গ্রেডে ২ হাজার ২৬০ জন কর্মরত। অর্থাৎ ওসব গ্রেডে মোট অনুমোদিত জনবলের বিপরীতে ১ হাজার ৬৬৪ জন ঘাটতি রয়েছে। সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে প্রথম থেকে নবম গ্রেড পর্যন্ত কর্মরতদের ধরা হয়। গ্রেড ১০ থেকে ১২ গ্রেডের অধীনে কর্মরতদের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা বলা হয়। ওই তিন গ্রেডে অনুমোদিত পদ সংখ্যা ৪ হাজার ৯৬৭ হলেও ৩ হাজার ৩২২ জন কর্মরত। ওই হিসাবে সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় ১ হাজার ৬৪৫ জন দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তার ঘাটতি রয়েছে। আর গ্রেড ১৩ থেকে ১৬-ভুক্তদের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী বলা হয়। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় এ চার গ্রেডে অনুমোদিত পদের বিপরীতে ২ হাজার ১৬৫ জন কর্মচারীর ঘাটতি রয়েছে। তাছাড়া চতুর্থ শ্রেণী বা ১৭-২০ গ্রেডে ৫ হাজার ৭২ জন অনুমোদিত পদ সংখ্যার বিপরীতে ৩ হাজার ৫৪২ জন কর্মরত রয়েছে। অর্থাৎ সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় শেষ চার গ্রেডে অনুমোদিত পদের বিপরীতে ১ হাজার ৫৩০ জনের ঘাটতি আছে। তবে প্রথম থেকে চতুর্থ পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শ্রেণীবিন্যাস ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার সময় আনুষ্ঠানিকভাবে রহিত করে গ্রেডভিত্তিক শ্রেণীকরণ করা হয়। কাগজে-কলমে এ শ্রেণীভিত্তিক পরিচয় এখন আর নেই। গ্রেডের ভিত্তিতে সবার পদমর্যাদা উল্লেখ করা হয়।
এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসনে ওপরের দিকে কর্মকর্তার সংখ্যা অনুমোদনের অতিরিক্ত হওয়ায় তা মাথাভারী প্রশাসন হয়ে ওঠেছে। ফলে নিচের গ্রেডের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি কর্মসম্পাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। অসামঞ্জস্যের কারণে প্রশাসন বা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাস্তবায়ন লঙ্ঘন হয়। তাছাড়া অনেক দিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় বেড়ে যায়। প্রজাতন্ত্রের জনসেবাসংক্রান্ত প্রাথমিক কাজগুলো করে নিচের স্তরের লোকজন। সেখানে অনুমোদিত পদের তুলনায় লোকবল কমের কারণে কর্মসম্পাদনে প্রভাব পড়ে। আর ওপরের দিকে মাথাভারী হওয়ায় পদোন্নতি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। নিচের গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উচ্চতর পদে পদোন্নতির সম্ভাবনা ক্রমাগত সংকুচিত হয়। ওয়ার্কলোড অনুসারে জনবল নির্ধারণ করতে হয়। ১০ জনের কাজ যদি পাঁচজনে করে তখন ওয়ার্ক লোড বেশি হয়। কাজের গতি কমে যায়। কম লোক থাকায় জনগণেরও ভোগান্তি বাড়ে। ওপরের গ্রেডগুলোয় অনুমোদিত পদের চেয়ে বেশিসংখ্যক লোক থাকাটা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের একটা সমস্যা। মূলত সিভিল সার্ভিসের উচ্চ স্তরের কর্মচারীদের খুশি রাখার জন্য অনুমোদিত পদেও অতিরিক্ত প্রমোশন দেয়া হয়। ফলে অনুমোদিত পদ ও প্রকৃত পদে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে এ বিষয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানান, প্রমোশন দেয়ার সময় বেশকিছু বিষয় বিবেচনা করতে হয়। অতিরিক্ত সচিব যে কয়জন প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি রাখতে হয়। কারণ একটা অংশ কোনো প্রশিক্ষণ বা বিশেষ কার্যক্রমে যুক্ত থাকেন, কেউ কেউ অসুস্থ থাকেন, আবার আরেকটি অংশকে রিজার্ভে রাখতে হয়। বেশি প্রমোশন দেয়ার আরেকটি কারণ অল্প দিনের মধ্যেই কিছুসংখ্যক পিআরএলে চলে যান। আবার বিভিন্ন কারণে অনেকে ওএসডি হন, অনেককে ডেপুটেশনেও দিতে হয়। অনেকে লিয়েন নিয়ে পাঁচ বছরের জন্য দেশের বাইরে চাকরি করেন। নানা রকম বিষয় থাকে। প্রতি বছরই সরকার নবম গ্রেড থেকে ৩০০, ৩৫০ কিংবা ২৫০ জনকে নিয়োগ দিচ্ছে। চাইলেই সরকার বেশি নিয়োগ দিতে পারে না। কারণ এত লোক নিয়োগ দিলে অন্যান্যের প্রমোশনে জটিলতা তৈরি হতে পারে। কর্মকর্তাদের মধ্যে যাতে ফ্রাস্ট্রেশন তৈরি না হয় সেদিকটাও বিবেচনায় রাখা হয়। তাছাড়া আগে পদ সৃজন করতে হয়। পিরামিডের মতোই যত ওপরের দিকে যাবে পদের সংখ্যাও ছোট হয়ে আসবে। নিচের দিকে কর্মকর্তা বেশি থাকবে। সরকারের যতটুকু প্রয়োজন সেটুকুই রিক্রুট করতে হবে। সরকার কতজনকে নেবে, কতজন দরকার হবে সে ব্যাপারে পরিকল্পনা থাকে। ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের ভিত্তিতেই যথাযথভাবেই আগানো হচ্ছে।