বাংলাদেশ এখন আর ঠিক আগের জায়গায় নেই। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে টক্কর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ সংগ্রামের পর স্বাধীনতা পাওয়া এই দেশটি। করোনা মহামারীতে যদিও একটু ধাক্কা লেগেছে কিন্তু বাংলাদেশ তা ক্রমে কাটিয়ে উঠছে।
উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে চলমান রাখতে গৃহীত হচ্ছে নতুন নতুন পরিকল্পনা। মহা সব প্রকল্পের কাজ চলছে। কিছুকিছু প্রকল্প যদিও দীর্ঘসূত্রিতার বেড়াজালে থমকে আছে। কিন্তু এসব অনগ্রসর প্রকল্পের কথা বাদ দিলেও, অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ অগ্রসর হচ্ছে স্বাভাবিক গতিতে।
এসব উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান তথা 'ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০' অন্যতম। শতবর্ষের এ মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপ ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এ সময়ে ৮০টি প্রকল্পের আওতায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এরই ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোতে চলতি অর্থবছরে বিনিয়োগ হচ্ছে ৩৪ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি খসড়া ম্যাপিং চূড়ান্ত করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা। পাশাপাশি ডেল্টা উইং গঠনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। কাজ চলছে ডেল্টা ‘নলেজ ব্যাংক’ ও ‘ডিজিটাল তথ্য ভান্ডার’ স্থাপনের। আর সার্বিক কর্মকা-ের আর্থিক বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ডেল্টা তহবিল গঠনের। সুষ্ঠুভাবে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন আরও জোরালো করতে খুব শিগগির সংশ্লিষ্ট ১০ মন্ত্রীকে নিয়ে ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিলের চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, নেদারল্যান্ডস কে অনুসরণ করে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান তথা ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। বন্যা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, নদী ভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসেবে ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের অনুমোদন পায়। ২০২০ সালের ১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১২ সদস্যের ডেল্টা গভর্ন্যান্স কাউন্সিল গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রীকে ডেল্টা কাউন্সিলের ভাইস-চেয়ারম্যান করা হয়েছে।
কয়েক ধাপে এই মহাপরিকল্পনার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানা যায়। প্রথম ধাপে অর্থাৎ ২০৩০ সাল নাগাদ বাস্তবায়নের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে ৮০টি প্রকল্প। এর মধ্যে ৬৫টি ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প এবং ১৫টি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, দক্ষতা ও গবেষণা বিষয়ক প্রকল্প। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৭০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় ৩ হাজার ১৪৫ বিলিয়ন টাকারও বেশি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলো কখনও একক আবার কখনও যৌথভাবে কাজ করছে।
২০৩০ সালের মধ্যে মহা এই প্রকল্পের প্রথম ধাপের কাজ বাস্তবায়নের জন্য জানা যায় অর্থের যোগান নিশ্চিত করতে প্রতিবছর জাতীয় আয়ের ২ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে ২ শতাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সংগ্রহ করা হবে। বাকি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বেসরকারি খাত থেকে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ডেল্টা প্ল্যান তৈরিতে নেদারল্যান্ডস সরকার এরইমধ্যে ৮৭ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া এই মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ডেল্টা তহবিল গঠন করা হবে বলে জানা গেছে। দুটি ধাপে এটি করা হবে। প্রথম ধাপে ডেল্টা সংক্রান্ত সব ধরনের বিনিয়োগ ও পরিচালনা-রক্ষণাবেক্ষণ নির্বাহের জন্য এটি বিবেচিত হবে। তহবিলের সম্ভাব্য উৎস হিসাবে বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, পরিবেশ এবং জলবায়ু সম্পর্কিত তহবিল, বিশেষ করে গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব পিপিপি পদ্ধতিকে বিবেচনা করা হয়েছে।
নিরাপদ, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাতসহিষ্ণু সমৃদ্ধশালী ব-দ্বীপ গড়ে তোলাই মূলত এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। এর এজন্যই এর নামকরণ করা হয়েছে ডেল্টা প্ল্যান। এই প্রকল্পের চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ছয়টি হটস্পট। যেগুলো মূলত পানি ও জলবায়ু উদ্ভুত অভিন্ন সমস্যাবহুল অঞ্চল। এগুলো হচ্ছে-২৭ হাজার ৭৩৮ বর্গ কিলোমিটারের উপকূলীয় অঞ্চল। ২২ হাজার ৮৪৮ বর্গ কিলোমিটারের বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল। ১৬ হাজার ৫৭৪ বর্গ কিলোমিটারের হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল। ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। ৩৫ হাজার ২০৪ বর্গ কিলোমিটারের নদী অঞ্চল এবং মোহনা এবং ১৯ হাজার ৮২৩ বর্গ কিলোমিটারের নগরাঞ্চল।
এটি স্পষ্ট যে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে গাজীপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ময়মনসিংহ, নীলফামারী ও শেরপুর; এই জেলাগুলো সমুদ্র ও প্রবহমান নদী থেকে অবস্থানগত দূরত্বের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিমুক্ত। ফলে এই জেলাগুলোকে হটস্পটের আওতাভুক্ত করা হয়নি। পরিকল্পনায় সুস্পষ্টভাবে হটস্পট-ভিত্তিক সমস্যাগুলো আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে-ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা। নদী ও উপকূলীয় এলাকায়- ভাঙন, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া। বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ এলাকার সমস্যা-স্বাদু পানির প্রাপ্যতা, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা, পরিবেশের অবনমন। হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের সমস্যাগুলো হচ্ছে- স্বাদু পানির প্রাপ্যতা, আকস্মিক বা মৌসুমি বন্যা, জলাবদ্ধতা ও অপর্যাপ্ত নিস্কাশন, অপর্যাপ্ত পানি ও পয়ঃনিস্কাশন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমস্যাগুলো হচ্ছে- স্বাদু পানির স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা ও ক্রমহ্রাসমান জীববৈচিত্র সংরক্ষণ। নদী অঞ্চল ও মোহনার সমস্যা-বন্যা, পরিবেশের অবনমন, পানিদূষণ, পলিব্যবস্থাপনা ও নৌ-পরিবহন, নদীগর্ভের পরিবর্তন, ভাঙন ও নতুন চর জেগে ওঠা। এর মধ্যে যমুনায় ভাঙন ১৭৭০ হেক্টর, পদ্মায় ভাঙন ১২৯৮ হেক্টর, মেঘনার অববাহিকায় ২৯০০ হেক্টর।
জানা যায়, ডেল্টা প্ল্যানের সার্বিক সমন্বয়, বাস্তবায়ন, ত্বরান্তিত করা, পরিকল্পনা হালনাগাদ, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণের জন্য গঠন করা হবে ডেল্টা উইং। ইতোমধ্যে ডেল্টা উইং গঠনের প্রস্তাব প্রণয়ন করা হয়েছে। এর অধীনে একটি অধিশাখা ও ৬টি শাখা সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে।
এই মহাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উপকূলীয় অঞ্চলের দুর্ভোগ যে বহুলাংশে কমে আসবে, এবং পরিবেশের ভারসাম্য অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যান্য অনেক প্রকল্পের মতো এই প্রকল্পও যাতে দীর্ঘসুত্রিতার কবলে না পড়ে এজন্য সরকারকে যতœশীল থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।