বিচার চাওয়ার বা পাওয়ার অধিকার সবার আছে। একজন অপরাধীও আইনের দ্বারস্ত হওয়ার অধিকার রাখেন। নির্বিচারে মৃত্যু কখনো কাম্য নয়। নির্বিচারে মৃত্যু দেশের আইন ব্যবস্থার দুর্বলতাকে প্রকট করে তুলে। এতে অপরাধীর পাশাপাশি নিরীহ মানুষ অন্যায়ের শিকার হন।
বাংলাদেশে বিচার বহির্ভুত হত্যা বেড়ে গেছে বলে দেশে ও দেশের বাহির থেকে অভিযোগ উঠছে। বাংলাদেশে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের হত্যার ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের দায় কি বাহিনীগুলোর নাকি সরকারের নীতির?
এ প্রশ্নের জবাবে বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোন বাহিনীই বিচার বহির্ভূত হতাকা-ের অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু মূলত সরকারের সদিচ্ছার অভাবে এসব ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। তারা মনে করেন, সরকারগুলো এই ইস্যুতে রাজনৈতিক নানা বক্তব্য দিলেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধে কখনও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তবে সরকার এসব অভিযোগ মানতে রাজি নয়।
বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড প্রায়শ ঘটছে। তবে সিনহা হত্যা ঘটনায় তোরজোড় দেখা যাচ্ছে যা অন্যক্ষেত্রে দেখা যায় না। এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মীদের ভাষ্য, সিনহা সাবেক সেনা কর্মকর্তা, এবং তাঁর হত্যার ঘটনায় পুলিশ সদস্য জড়িত, তাই তদন্তসহ সব ক্ষেত্রে জোর তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের মুল কারণের দিকে নজর দেয়া হচ্ছে না এখনো।
নবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা পাওয়া গেছে ৬৭টি। অভিযোগ আছে, র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), নৌপুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা এসব হত্যাকা- ঘটিয়েছেন।
প্রথম সারির কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে আসক। সে হিসেবে দেশে প্রতি মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে ৬টিরও বেশি।
আসক'র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, এ সময়ের মধ্যে র্যাব ২৫টি, পুলিশ ১৯টি, ডিবি পুলিশ ৬টি, নৌপুলিশ ১টি এবং বিজিবি ১৬টি হত্যাকা- ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
অভিযোগটা র্যাবের বিরুদ্ধে গুরুতর বেশি। র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই বাহিনী গ্রেপ্তারের আগে 'ক্রসফায়ারে' ২৩টি এবং গ্রেপ্তারের পর 'ক্রসফায়ারে' ২টি হত্যাকা- ঘটায়। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, গ্রেপ্তারের আগে 'ক্রসফায়ারে' ২টি, গ্রেপ্তারের আগে 'নির্যাতনে' ১টি ও গ্রেপ্তারের পর 'নির্যাতনে' ৩টি হত্যাকা- ঘটায়।
এই ধরণের বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড যে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি মাথায় রেখে র্যাব এবং এর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে নিষেধাজ্ঞাটি দেওয়া হয়।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন অভিযোগকে একেবারে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ সরকার, যদিও পরবর্তীতে ব্যাপারটির গাম্ভীর্য উপলব্ধি করতে পারে। আশ্চর্য বিষয় হলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরপর দেশে ক্রসফায়ারে মৃত্যু থেমে গেছে। সূত্র জানায়, ওই নিষেধাজ্ঞা-পরবর্তী এক মাসে বাংলাদেশে কোনো ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেনি বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে তেমনটা দাবি করা হয়নি। এর আগে কক্সবাজারে বহুল আলোচিত মেজর সিনহা হত্যাকা-ের পরও ‘ক্রসফায়ারের’ ক্ষেত্রে একই রকম বিরতি লক্ষ করা গেছে। এভাবে বিশেষ বিশেষ ঘটনা বা পরিস্থিতির পর এই ‘ক্রসফায়ার-বিরতি’ জনমনে প্রশ্ন তৈরি করে, এটা কি কাকতালীয় না ইচ্ছাকৃত? একই সঙ্গে কিছু পুরোনো প্রশ্নও ঘুরেফিরে সামনে আসে, ক্রসফায়ার কি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে, না এটা ঘটানো হয়? সরকার চাইলে এটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করা কি অসম্ভব? বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করা, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার কি আদৌ আন্তরিক?
বর্তমান বিশ্বের মোড়ল হলো যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের জারিকৃত নিষেধাজ্ঞার পর তার ফলাফল বা প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনা হয়েছে। অনেকে অনেক রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, অনুমান-আশঙ্কা প্রকাশ করলেও প্রাথমিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে খুব বেশি পাত্তা দেওয়া হচ্ছিল না। কোনো কোনো মন্ত্রীর কথায় মনে হয়েছে, এ নিষেধাজ্ঞায় তাঁদের কিছুই যায় আসে না এবং এর কোনো গুরুত্ব নেই। তবে পরিস্থিতি অনুধাবন করে সরকার দ্রুতই তার অবস্থান পরিবর্তন করে। ২ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বলেন, নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন।
এটি স্পষ্ট যে, দল মতের উর্ধ্বে গিয়ে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু এই জায়গাটায় বাংলাদেশে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই অভিযোগ শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ বা বিদেশি সংস্থাগুলোই করছে না, দেশীয় সংস্থাগুলোও একই রকম কথা বলছে। ২০২১ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর একাধিক মানবাধিকার সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংবাদ সম্মেলনে ২০২১ সালকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একই দিন অন্য একটি অনুষ্ঠানে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল খুবই তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলেন, ‘আমরা তো কিছু না করেই ভয়ের মধ্যে আছি, একটা ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করছি। কতজন মানুষ আছে, যারা শান্তিতে দিন কাটাতে পারছে। মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে ন্যায়বিচার পাবেন, এই বিশ্বাস কতজনের মধ্যে রয়েছে?'
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ক্রসফায়ারের পাশাপাশি গুম হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তাঁদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করছে। তাঁদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। উধাও হয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা আসলেই গুম হয়েছেন কি না, তা জানতে চাইছেন। পুলিশ নিজেদের মতো করে লিখে তাঁদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে রেখে দিচ্ছে। এমনকি তাঁরা গুম হননি, আত্মগোপনে চলে গিয়েছেনÑএমন কিছু লিখতে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে যথারীতি পুলিশ এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
মানবাধিকারের প্রসঙ্গে বাংলাদেশকে সহনশীল হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা এই জায়গায় অগ্রগতি দেখাতে না পারলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, এবং একইসাথে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।