প্রতিনিয়ত রাজধানীতে নতুন নতুন মানুষ ঢুকছে। আগে থেকে জনাকীর্ণ এই শহর হয়ে উঠছে আরও জনাকীর্ণ। শহরে বসবাসরত মানুষের অবস্থা হয়ে উঠছে দুর্বিসহ। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রের ওপর থেকে ক্রমবর্ধমান চাপ কমাতেই পূর্বাঞ্চলে আধুনিক স্যাটেলাইট শহর গড়ার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২৬ বছর পার হতে চলেছে, পূর্বাঞ্চলের স্যাটেলাইট শহর আর গড়ে উঠছে না।
জানা যায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প বাংলাদেশ সরকারের একটি উন্নয়ন প্রকল্প যার উদ্দেশ্য ঢাকা মহানগরীর অদূরে পূর্বাচল এলাকায় একটি আধুনিক ‘টাউনশীপ’ স্থাপন করা। এর জন্য রূপগঞ্জ থানা ও কালিগঞ্জ থানা এলাকার ৬,১৫০ একর জমি নির্বাচন করা হয়েছে। এখানে ২৬ হাজার আবাসিক ভবন স্থান এবং ৬২ হাজার এপার্টমেণ্ট নির্মাণ করা হবে। এই টাউনশীপকে ৩০টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে।
এটি রাজউক এর একটি প্রকল্প। ১৯৯৫ সালে রাজধানী ঢাকার সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে ‘পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প’ গৃহীত হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়েছে ৬৮ শতাংশ। জানা যায়, প্রকল্পটিতে প্রতিবছর নতুন নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা যোগ হচ্ছে। ফলে এ প্রকল্পের সাথে যাদের স্বপ্ন জড়িয়ে রয়েছে তাদের ক্ষোভের আর শেষ নেই। অনেকে প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা দেখেও যেতে পারেননি, চলে গেছেন পরপারে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে অবশ্য বরাবরের মতো আশার বাণী নিঃসৃত হচ্ছে। রাজউক চেয়ারম্যান সর্বশেষ জানিয়েছেন, ২০২২ সালের মধ্যেই পূর্বাচল প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ সেক্টরের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। সেক্টরগুলোকে বিদ্যুৎ লাইনের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। ভবন বানানোর জন্য নকশা অনুমোদনও করা হচ্ছে। পূর্বাচলে যারা প্লট পেয়েছেন তারা এখনই বসবাস করতে চাইলে তাকে প্রয়োজনীয় সেবাগুলো দেয়া হবে।
প্রকল্প এলাকার ভেতরে চারটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় করার কথা রাজউকের। চেয়ারম্যান চলতি বছরের মধ্যে প্রকল্প শেষ করার আশ্বাস দিলেও সূত্র জানায়, প্রকল্পের কেবল দুটি ভবনের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। স্কুল চালু হয়নি। প্রকল্প এলাকায় আগের ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। সেগুলোর জন্য প্রকল্পে জায়গা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু স্কুলগুলো সেক্টর ধরে স্থানান্তর হয়নি। প্রকল্পে একটি সরকারি হাসপাতাল থাকার কথা। সেটির নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। ৩০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে হাসপাতাল করার জন্য জায়গা দেওয়া হয়েছে। তারা কেউ সেখানে হাসপাতালের কাজ শুরু করেনি। প্রতি সেক্টরে একটা করে বাজার থাকার কথা। এখনো কোনো বাজার তৈরি করা হয়নি।
এসবের পাশাপাশি সূত্র জানায়, প্রকল্পে এখনো স্যুয়ারেজ লাইন হয়নি। হয়নি ফুটপাত। আগে করা রাস্তাগুলো খানাখন্দ হয়ে গেছে।
জানা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় ছিল চারটি থানা। এজন্য জমিও বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বরাদ্দকৃত জমিতে বলার মতো কোনো কাজ হয়নি। এই তথ্য নিশ্চিত করেছে রাজউক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, তারা কোন থানার অধীনে কোন এলাকা থাকবে তা নিয়ে কাজ করছে এখন।
প্রকল্পের বয়সসীমা শুধু বাড়ছে আর বাড়ছে। চেয়ারম্যান চলতি বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আশ্বাস দিলেও জানা যায় সর্বশেষ প্রকল্পটির সময়সীমা ২০২৫ সাল নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির সময়সীমা ২০২৫ সাল নির্ধারণ করা হলেও শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত সময়ে তা সম্পন্ন হবে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল সন্দেহ পোষণ করছেন। কারণ এর আগে কয়েক দফা প্রকল্পটি শেষ করার সময় নির্ধারণ করেও তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। বারবার নতুন নতুন প্রকল্প যুক্ত করে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। শুরুতে ১০ লাখ মানুষের বসবাস উপযোগী শহর বলা হলেও এখন সর্বশেষ নকশা অনুসারে এ প্রকল্পে ২৭ লাখ মানুষ বাস করবে। এতে শেষ পর্যন্ত তা বাসযোগ্য থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
এই প্রকল্পের সাথে পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণেরও একটি বিষয় আছে। কেননা এই প্রকল্প সংলগ্ন অঞ্চলে আছে বন। জানা যায়, কালিগঞ্জের পারাবর্ত ও বড়কাউ মৌজার বনাঞ্চল ঠিক রেখে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৭ সালে রাজউককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পরিবেশবাদীদের এক রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের ওই আদেশে বলা হয়, প্রকৃতি ঠিক রাখার শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র মিললে এই দুই এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে।
বনের বিষয় সম্পর্কে পরিস্কার হতে না পেরে জানা যায়, পরিবেশ অধিদপ্তর এখনো রাজউককে কোনো ছাড়পত্র দেয়নি। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ভাষ্য, 'হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছি। রাজউক আদালতের নির্দেশনা অনুসরন করলে আমরা ছাড়পত্র দেব। তবে ছাড়পত্র দেওয়ার মতো অবস্থা এখনো দৃশ্যমান নয়।'
তবে পূর্বাচলের সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান উন্নয়ন কাজটি হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার স্থায়ী প্যাভিলিয়ন নির্মাণে। এটা করা হয়েছে ঢাকা মহানগর বাইপাসের পাশে ৪ নম্বর সেক্টরে। বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন নামে দৃষ্টিনন্দন এ প্যাভিলিয়ন দেখতে এখনি দর্শনার্থীদের ভিড় হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো রূপগঞ্জের রাজউক পূর্বাচলের স্থায়ী প্যাভিলিয়নেই অনুষ্ঠিত হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা।
এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় অত্যাধুনিক সড়ক নির্মানের কাজও চলছে। কাজ অনেকদূর এগিয়েও গেছে। জানা যায়, ২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কুড়িল থেকে কাঞ্চন পর্যন্ত চার লেনে সম্পন্ন করা ৩০০ ফুট রাস্তার পুরোটাই ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) উজ্জ্বল মল্লিক বলছেন, নতুন পরিকল্পনায় আট লেনের রাস্তাটি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চলাচলের জন্য উপযোগী হবে। এটি হবে একটি দৃষ্টিনন্দন রাস্তা। ইন্টারসেকশনগুলোতে এমনভাবে রাস্তা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে তাতে রাস্তাগুলো মনে হবে দোতলা। কোথাও যানজট হবে না, যানজট হওয়ার যেসব বাধা থাকে- এই রাস্তায় তা থাকবে না।
তবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প প্ল্যানিং ব্যর্থতার একটি বীভৎস নজির। একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এই যে কালক্ষেপন করা হচ্ছে তাতে ব্যয় যেমন বাড়ছে, প্রকল্পে যারা প্লট বরাদ্দ করেছেন তাঁদের দুর্ভোগও বাড়ছে।