প্রকৃতিতে শীত চললেও, ভোজ্য তেলের বাজার চলছে উত্তাপ। মুহুর্মুহু ভোজ্য তেলের দাম বাড়ায় সাধারণ ক্রেতাদের অবস্থা নাকাল। এক বছরেরও অধিক সময় ধরে ভোজ্য তেলের এই তেলেসমাতি চলছে। আর ক্রেতাদের যুজতে হচ্ছে বাড়তি চাপ। কেননা, তাঁদের আয় তো বাড়ছে না কানাকড়িও। বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে, এজন্য দেশের বাজারেও বাড়ানো হয়েছে-- ব্যবসায়ীদের খুব সহজ ফর্মুলা এটি। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম কমলে তখন সে ফর্মুলার কথা আর মনে থাকে না তাদের। দেশের বাজারে তখন আর দাম কমে না। এর মধ্যে সরকার সয়াবিন ও পাম অয়েলের ওপর ৪ শতাংশ অগ্রিম কর প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তবুও বাজারে ভোজ্য তেলের দাম কমেনি এক টাকাও।
সূত্র জানায়, ভোজ্য তেলের দামের এই লাগামহীন উত্থানের পেছনে মূলত হাত আছে ব্যবসায়ীদের। তাঁরাই ভোজ্য তেলের বাজারকে সহনশীল হতে দিচ্ছে না। গত ১৯ জানুয়ারি সচিবালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছিলেন, আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি আবার বৈঠক করে দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর আগে সয়াবিন-পাম অয়েলের দাম আর বাড়বে না। কিন্তু ব্যবসায়ীরা মন্ত্রীর সেই বক্তব্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার আগেই নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের হাত এত চওড়া হয় কীভাবে, সরকার ও প্রশাসনকেও তারা কীভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন এ নিয়ে গুঞ্জন চলছে সংশ্লিষ্ট মহলে। তাঁদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে একটি সিন্ডিকেট দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের বাজার অস্থির করে তুলেছে। তারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির পেছনে সরকারের একটি অংশের মৌন মদদ আছে বলেও অভিযোগ আছে। সরকারের অনুমোদন ছাড়া কীভাবে ভোজ্যতেলের দাম বাড়লÑএ প্রসঙ্গ নিয়ে নানা মহলে গুঞ্জন উঠলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানান,‘ব্যবসায়ীরা নিজেরা দাম বাড়াতে পারেন না। এ ব্যাপারে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হবে।’
সূত্র জানায়, রুপচাঁদা ও তীরের পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনের গায়ের দর ৮০০ থেকে ৮২০ টাকা লেখা আছে। তবে বাজারে তা ৭৬০ থেকে ৭৭০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে এই পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ৭৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর বসুন্ধরার পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেল বর্তমান মূল্য ৭২০ থেকে ৭৩০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ৬৯০ থেকে ৭০০ টাকায় সীমিত ছিরল।
ভোজ্য তেলের বাজারের এই অস্থিতিশীলতার বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়ার ভাষ্য, বিশ্ববাজারে যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়ে তখন সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা দেশের বাজারে দাম বাড়িয়ে দেন। যেটা আমরা গত কয়েক মাস সয়াবিন ও পাম অয়েলের ক্ষেত্রে দেখেছি। গত দুই মাস যখন বিশ্ববাজারে দাম কমেছে, তখন ব্যবসায়ীদের উচিত ছিল দেশের বাজারে দাম কমানো। ওই দুই মাস অবশ্যই ব্যবসায়ীরা ১০০ ডলার কম দিয়ে প্রতিটন সয়াবিন কিনেছেন। সেই তেল তারা এখন দেশের বাজারে বিক্রি করছেন, কিন্তু সেই চড়া দামেই। ক্যাবের পক্ষ থেকে তো নিয়মিত বাজার মনিটরিং করি, কিন্তু অবাক হয়ে প্রত্যক্ষ করলাম, দেশের বাজারে এক টাকাও কমেনি ভোজ্য তেলের দাম। বরং প্রতিনিয়ত হু হু করে বাড়ছে। মানুষ এমনিতেই বিভিন্ন রকম কষ্টে আছে। ভোজ্য তেল গত প্রায় এক বছর ধরে কষ্ট দিচ্ছে। ব্যবসায়ীদের চাপে সরকার নতুন করে যেন ভোজ্য তেলের দাম আর না বাড়ায়।
ব্যবসায়ীরা বরাবরের মতো বিশ্ববাজারের উর্ধ্বমুখীতাকেই দোষারোপ করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় এ সময়ে দেশেও সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে। সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর এই পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল হলেই কেবল দেশের বাজার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোতে সয়াবিনের মজুত কমে যাওয়ার কারণেই মৌসুমের শেষ দিকে এসে পণ্যটির দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টদের ধারণা। আর ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াকেন্দ্রিক পাম তেলের দাম বাড়ছে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার কারণে। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় সয়াবিনের মজুত কমে যাওয়া ও খরায় নতুন আবাদ বিলম্বিত হওয়ার কারণেও দাম বাড়ছে। ব্রাজিল কিছুটা চড়া দামে পণ্য দিলেও আর্জেন্টিনা আপাতত রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এসব কারণে বাজার বেশ অস্থিতিশীল।
সামনে রমজান-ঈদ আছে। পৃথিবীজুড়ে এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় ডিসকাউন্ট চলে, আমাদের এখানে উল্টোটা, ঈদ এলেই দাম বাড়ে। ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম কমাতে না পারলে, তাঁদের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আসন্ন রমজান মাসে যে সাধারণ মানুষের জন্য অনেক ভোগান্তি অপেক্ষা করছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
জানা যায়, সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক বছরে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ২৮ শতাংশ, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশ, খোলা সয়াবিন তেলে ২৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ, পাম অয়েল ৩৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও সুপার পাম অয়েলে ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে এক বছরের কিছু বেশি সময়ের হিসাব ধরলে দাম বাড়ার ব্যবধানটা অনেক বেশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত সরিষা, সূর্যমুখীসহ অন্যান্য তেলবীজ থেকে সোয়া ২ লাখ টন তেল পাওয়া যায়। বাকিটা আমদানি করতে হয়।
ব্যবসায়ীরা যতোই বিশ্ববাজারের উর্ধ্বমুখীতাকেই দোষারোপ করুক না কেন দেশের বাজারকে অস্থিতিশীল করার পেছনে তাঁদের কারসাজি কারও কাছেই অজানা নয়। অগ্রিম কর প্রত্যাহার করার পরও তারা বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলে। তাঁদের অতি মুনাফা লোভই ভোজ্য তেলের বাজার মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা সরকারকে বাজার তদারকিতে কঠোরতা অবলম্বনের পরামর্শ দিচ্ছেন।