দখল ও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেশের অধিকাংশ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। ইতিমধ্যে অসংখ্য প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় ৫১৮টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি রয়েছে। তার মধ্যে গত দুই দশকে ১৭৮টি প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনকে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে। তবে গেজেটভুক্ত করার পর জনবল সংকটসহ নানা কারণে ওসব প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে হাতে গোনা যে কয়টি নিদর্শন এখনো টিকে আছে সেগুলোও এখন নষ্ট হওয়ার পথে। সর্বশেষ গত ২০ বছরে যে ১৭৮টি স্থাপনাকে গেজেটভুক্ত করা হয় তার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২১টি, খুলনা বিভাগে ৪৪, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ২৫ এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে ৬৭টি নিদর্শন রয়েছে। বাকি নিদর্শনগুলোর অবস্থানও দেশের বিভিন্ন স্থানে। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরে যথেষ্ট লোকবল না থাকায় দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনের সর্বোচ্চ দেখভাল করা প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেশের অধিকাংশ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন দখল ও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিগত দুই দশকে দেশের খুলনা অঞ্চলে ৪৪টি প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন গেজেটভুক্ত হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে লোকবল না থাকায় অনেক নিদর্শনই নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে খুলনার কয়রার ধোপখোলা মসজিদটি ভেঙে নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। যশোরের ঝিকরগাছার কয়েম খোলা মসজিদটি ভেঙে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ঝিনাইদহের পঞ্চরতœ মন্দিরটিও সংস্কার করে ব্যবহার করা হচ্ছে। মাগুরার শ্রীপুরে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের স্মৃতিবিজড়িত ভবনটি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে পাওয়া পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী হিসাব করলে বাংলাদেশে জনবসতি প্রায় ৪ হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছিল। তারপর সময়ের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর পরিবর্তন হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে, নতুন নতুন শাসক এ অঞ্চলের ছোট ছোট রাজ্য শাসন করেছে। সময়ের প্রতিটি ধাপই এ ভূখ-ে তার নানা নিদর্শন রেখে গেছে। কিন্তু যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা হলে প্রাচীন ওসব স্থাপনা ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে। তাছাড়া ওসব প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংসের আরেকটি বড় কারণ হলো দখল হয়ে যাওয়া। সরকারের নির্দিষ্ট অধিদপ্তরের যথাযথ তদারকি না থাকায় বহু স্থাপনা ও স্থাপনার ভূমি অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে গেছে। তার মধ্যে কোনো কোনোটি দখলমুক্ত করা হলেও পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ সুবর্ণগ্রামকে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করেন। ওই সুবর্ণগ্রামই বর্তমানের সোনারগাঁ। বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন তৈরি ও কেনাবেচার প্রসিদ্ধ বাজার ছিল সোনারগাঁর পানাম নগরে। ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ডের করা বিশ্বের ১০০ ধ্বংসপ্রায় নগরীর তালিকায় পানাম নগরের স্থান হয়। ওই বছরই গেজেট জারির মাধ্যমে পানাম নগর প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীন করে দেয়া হয়। কিন্তু যথেষ্ট তদারকি থাকায় ঐতিহাসিক ওই নিদর্শনটির ১২ একর জমি দখলের চেষ্টা করে দখলদাররা। দায়ের করা হয় ৬টি মামলা। ঢাকার আরেক নিদর্শন লালবাগ কেল্লারও একই অবস্থা। তার ভেতরের দশমিক ১২ একর ভূমিও দখল হয়ে গিয়েছিল। তবে সেখান থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর। এভাবেই প্রতিনিয়ত দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতত্ত্ব নিদর্শনগুলো দখল করে নেয়ার চেষ্টা চলে।
সূত্র আরো জানায়, এদেশের মানুষ প্রতœতাত্ত্বিক সম্পত্তির গুরুত্ব বোঝে না। আবার ওসব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তাও বরাদ্দ পাওয়া যায় না। এমনও নিদর্শন আছে যেখানে বছরের পর বছর অধিদফতরের কর্মকর্তারা পরিদর্শনে যেতে পারে না। গেজেট প্রকাশ হওয়ার পর একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়েই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। তারপর অধিদফতরের কর্মকর্তাদের আর কখনোই পরিদর্শনে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এমন খবর পেলেও বেশির ভাগ সময় অধিদফতরের কিছু করার থাকে না।
এদিকে এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম শাহনাওয়াজ জানান, রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাই প্রতœতত্ত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন নন। ফলে প্রতœতত্ত্ব সংরক্ষণে বরাদ্দ কম থাকে। আর এতো অল্প বাজেটে এতো কম জনবল দিয়ে প্রতœতত্ত্ব নিদর্শন সংরক্ষণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ অসচেতন বলেই তারা ওসব পুরাকীর্তি দখল করতে চায়। কেবল সাধারণ মানুষই নয়, সরকারের উচ্চ পর্যায়েও এ সম্পর্কে জ্ঞান আছে এমন মানুষের সংখ্যা কম। ওই কারণেই কেবল অল্প জনবলের একটি অধিদপ্তরের পক্ষে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন নিদর্শনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। সেজন্য সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক রাখি রায় জানান, লালবাগ, পানাম নগর, হাজীগঞ্জ দুর্গ, রাজাশন ঢিবিসহ বেশ কয়েকটি প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে দখলমুক্ত করা হয়েছে। ওসব নিদর্শন দখলমুক্ত রাখতে বা সবসময় তদারকি করতে যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন অধিদপ্তরের কাছে তা নেই। ফলে চাইলেও সবসময় অনেক উদ্যোগ নেয়া যায় না।