বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। গত ৫ বছরে তা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। অথচ দেশের বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে। লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেও তা বাড়ানো যায়নি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩১১ কোটি ডলার। কিন্তু মহামারীসৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্বিপাকের মধ্যেও চলতি বছরের জুন শেষে তা ১ হাজার ৮৬৮ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। ওই হিসেবে দেড় বছরে দেশের বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ৫৫৭ কোটি ডলার। ডলারের বর্তমান বিনিময় হারকে হিসাবে নিয়ে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের এখনকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তার মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ১৮০ কোটি ডলার বা ৬৩ শতাংশ আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৬৮৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের বিদেশী ঋণ গ্রহণের সবচেয়ে বড় উৎস হলো হংকং। ওই দেশটি থেকে বাংলাদেশী শিল্পোদ্যোক্তারা চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৬৩ কোটি ৪১ লাখ ডলারের দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ নিয়েছে। আর বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ঋণদাতা শীর্ষ ১০টি দেশ হলো চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, জার্মানি, জাপান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বহুজাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেও বিদেশী ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশী শিল্পোদ্যোক্তারা। এক দশক আগে লাইবর ছিল ৬ শতাংশেরও বেশি। তবে বর্তমানে লাইবরের সুদহার গড়ে দশমিক ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। চলতি সপ্তাহে এক বছর মেয়াদি লাইবর সুদহার ছিল দশমিক ২৭ শতাংশ। ৬ মাস মেয়াদি লাইবর দশমিক ১৮ শতাংশ এবং এক মাসের কম মেয়াদ লাইবর দশমিক শূন্য ৯ শতাংশের নিচে নেমেছে। লাইবরের এই নিম্ন সুদহারকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশী বড় শিল্পোদ্যোক্তারা কমিশন, ফিসহ সর্বোচ্চ ২ শতাংশ সুদে বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারছে। দেশের বেসরকারি খাতে বিগত ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণের পরিমাণ ছিল ৯২৫ কোটি ডলার। পরের ৩ বছর ওই ঋণ স্বাভাবিক গতিতেই বেড়েছে। কিন্তু গত বছর মহামারী শুরুর পর ওই ঋণপ্রবাহ দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। গত বছরেই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ মিলিয়ে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১ হাজার ৪৭৬ কোটি ডলার, যা চলতি বছরের জুন শেষে ১ হাজার ৮৬৮ কোটি ৮৪ লাখ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
সূত্র জানায়, করোনাসৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে উন্নত দেশ ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কাছে বিনিয়োগযোগ্য অলস তারল্যের পাহাড় গড়ে ওঠেছিল। লন্ডন ইন্টার-ব্যাংক অফারড রেট (লাইবর) ইতিহাসের সর্বনি¤েœ নেমে আসে। ওই সুবাদে দেশের বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বোচ্চ ২ শতাংশ সুদেই বিদেশী ঋণ নিতে পেরেছে। তাছাড়া উদ্যোক্তাদের বিদেশী ঋণ গ্রহণের প্রক্রিয়া এবং শর্তও এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় সহজ করা হয়েছে। তাছাড়া পুরনো বিদেশী ঋণ পরিশোধে ডেফারেল সুবিধাও (ঋণ পরিশোধে বাড়তি সময়) উদ্যোক্তারা পেয়েছে। আর সুবিধার কারণেই বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের উচ্চপ্রবৃদ্ধির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সূত্র আরো জানায়, আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থায় বিদেশী ঋণকে ফাইন্যান্সিয়াল হেজিংয়ের আওতায় আনা হয়। যা ডলারের মূল্য বৃদ্ধিজনিত সংকটের ঝুঁকি থেকে গ্রাহককে অনেকটাই সুরক্ষা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য বিদেশী ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে হেজিং সুবিধা নেই। ফলে ডলার বিনিময় বেড়ে গেলে স্বল্প সুদের যে সুবিধা উদ্যোক্তারা পায় তা ডলারের বিনিময় হারেই উবে যাবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণ হলো, দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলেই ডলারের বিনিময় হার ৯০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিদেশী ঋণ শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। অথচ দেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, খাদ্য উৎপাদন, টেক্সটাইল, ওষুধ, সিরামিক, যন্ত্রপাতি, গাড়ি, সিমেন্ট, রাবার, প্লাস্টিক, তামাক, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন দেশ ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ঋণ দিচ্ছে। বেসরকারি খাতের প্রায় ৬৮৯ কোটি ডলার বিদেশী মেয়াদি ঋণের মধ্যে ট্রেড ক্রেডিট ও ডেট সিকিউরিটিজও রয়েছে। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণের মধ্যে রয়েছে বায়ার্স ক্রেডিট, ডেফার্ড পেমেন্ট, রফতানি খাতের বিল ডিসকাউন্ট, বিদেশী ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র ও স্বল্পমেয়াদি ডেট লায়াবিলিটিজ। বেসরকারি খাতে বিদেশী ওই ঋণপ্রবাহের প্রধান মাধ্যম ব্যাংকগুলোর অফশোর ইউনিট। দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৬টির অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে আছে। তাছাড়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (বিডা) অন্যান্য কিছু মাধ্যমেও বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বিতরণ হয়।
এদিকে বেসরকারি খাতে মাত্রাতিরিক্ত বিদেশী ঋণে বিশেষজ্ঞরা সার্বিক অর্থনীতির জন্য বিপদের আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছে। তাদের মতে, দেশে ডলারের বাজার অস্থিতিশীল। ঋণ পরিশোধের সময়ে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা উল্টো ক্ষতির মুখেও পড়তে পারে। গত কয়েক বছরে সরকারও বড় বড় প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ নিয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে সুদসহ ওসব বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। সরকারি ঋণের পাশাপাশি বেসরকারি ঋণ পরিশোধের চাপে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নড়বড়ে পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। বড় উদ্যোক্তারা দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের কিস্তিই ঠিকমতো পরিশোধ করছেন না। একই ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে। আর বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রেও এর পুনরাবৃত্তি ঘটলে আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের শীর্ষ নির্বাহী মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা জানান, এ মুহূর্তে বেসরকারি খাতের জন্য বিদেশী ঋণ অনেক বেশি সস্তা। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিদেশী ঋণপ্রাপ্তির প্রক্রিয়াটিও অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে। যে কারণে গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে ব্যাংকগুলো অফশোর ব্যাংকিংয়ের পরিধি বড় করছে। অন্যদিকে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিচ্ছে। ওসব কারণে বিদেশী ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। বিদেশী ঋণ নিতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে জামানত বা গ্যারান্টি দিতে হচ্ছে না। যে কারণে বড়রা ওই ঋণ নিতে বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। গ্রাহকরাও নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করছে। তবে বিদেশীদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে শুরু করলে তা দেশের জন্যই অমঙ্গল ডেকে আনবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, বিদেশ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ এনে উদ্যোক্তারা যদি রফতানি খাতসহ অর্থনীতিতে বাড়তি অবদান রাখতে পারে তা ইতিবাচক। তবে দেখতে হবে ঋণের অর্থ যথাযথ খাতে ব্যবহার হচ্ছে কিনা। যথাসময়ে ঋণটি পরিশোধ করাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিদেশী ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তারপরও মধ্যস্থতাকারী ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাকে বিদেশী ঋণের যথাযথ ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আরো কঠোর হবে।