জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ কেনার চেয়ে শিল্প মালিকরা ক্যাপটিভেই বেশি আগ্রহী। কারণ জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ কিনতে প্রতি ইউনিটে প্রায় দ্বিগুণ মূল্য গুনতে হয়। ফলে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুতের প্রাচুর্য থাকলেও শিল্প মালিকরা তাতে খুব একটা আগ্রহী হচ্ছে না। জাতীয় গ্রিড থেকে শিল্প খাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে খরচ পড়ে গড়ে ৮ টাকা ৫০ পয়সা। তবে সঞ্চালন লাইনের ভোল্টেজের ওপর ভিত্তি করে ওই দাম কোনো ক্ষেত্রে কম বা বেশি নির্ধারিত রয়েছে। আর ক্যাপটিভে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হচ্ছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ টাকার মতো। আর্থিকভাবে লাভজনক বিবেচনায় শিল্প মালিকরা ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসতে চাইছে না। সেক্ষেত্রে ক্যাপটিভের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো কিংবা জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ কিনতে প্রণোদনা না থাকার বিষয়টিও ভূমিকা রাখছে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। শিল্প মালিক এবং বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। যদিও চাহিদার ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত দৈনিক সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৩ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। উৎপাদনের একটা অংশ আবার শিল্প-কারখানায় সরবরাহের জন্য স্থাপিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। ক্যাপটিভ কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশেরও বেশি আসছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০-এর তথ্যমতে, ২০১০-১২ সময়ে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১৭ দশমিক ৮৪ শতাংশই ক্যাপটিভের ছিল। আর ২০১৩-১৫ সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্যাপটিভের অংশ ছিল ১৬ শতাংশ। ২০১৮ শেষে তা ১৪ শতাংশে দাঁড়ায়। আর ২০১৯-২০ শেষেও ক্যাপটিভ থেকে উৎপাদন হয়েছে মোট বিদ্যুতের ১১ শতাংশ। বিদ্যুতের মোট উৎপাদনে ক্যাপটিভের অংশ কমে এলেও আগের তুলনায় ওসব কেন্দ্রের উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৬ সালে ক্যাপটিভ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ওসব কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে ওই সক্ষমতা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলোসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ১৭১ মেগাওয়াট। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) হিসাবে বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর স্থাপিত উৎপাদন সক্ষমতা ২১ হাজার ৯৬৭ মেগাওয়াট আর প্রকৃত উৎপাদন সক্ষমতা ২১ হাজার ২১৯ মেগাওয়াটের মতো। কেন্দ্রের স্থায়িত্ব, উৎপাদিত বিদ্যুতের মান ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা (ডিরেটেড ক্যাপাসিটি) নির্ধারণ করা হয়। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৩৭৭ মেগাওয়াট। ১২ এপ্রিল সর্বোচ্চ পরিমাণ ওই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বিবেচনায় গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৫৬ শতাংশ। তারপরে রয়েছে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা মোট বিদ্যুতের ৩৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। তাছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ। তাছাড়া মোট উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৩ শতাংশ ও ১ দশমিক ১৭ শতাংশ যথাক্রমে কয়লা ও জলবিদ্যুতের। তার বাইরে সৌরবিদ্যুৎ রয়েছে। যদিও অপচয় হচ্ছে এমন কারণ দেখিয়ে সরকার ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে আনতে চাইছে। ইতিমধ্যে ক্যাপটিভে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। ১ হাজার ৭০০-এর বেশি শিল্প-কারখানায় ক্যাপটিভ বিদ্যুতের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সেগুলোতে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে।
এদিকে গ্যাস সংকটের কারণে ২০১০ সাল থেকেই আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত বিশেষ কমিটির বিবেচনায় শিল্পে গ্যাস সংযোগ অব্যাহত রয়েছে। এ বিশেষ বিবেচনায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ক্যাপটিভ পাওয়ারের অনুমোদন নিচ্ছে। আবার কেউ কেউ গ্যাস সংযোগ না পেয়ে ডিজেলভিত্তিক ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট বসাচ্ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি), রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট (আরপিপি), কমার্শিয়াল পাওয়ার প্লান্ট (সিআইপিপি), স্মল পাওয়ার প্লান্ট (এসপিপি) ও ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টসহ আরো কয়েকটি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়। তবে তার মধ্যে ক্যাপটিভের লাইসেন্সের আবেদনই সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ফজলুল হক জানান, জাতীয় গ্রি থেকে বিদ্যুৎ নিতে ব্যয় তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। অন্যদিকে সঞ্চালনের দুর্বলতার কারণে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রাপ্তিও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অথচ শিল্পোৎপাদনে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ক্যাপটিভ কেন্দ্রকেই এখনো নির্ভরতার জায়গা হিসেবে দেখছেন শিল্প মালিকরা।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (বিআইপিপি) চেয়ারম্যান ইমরান করিম জানান, সরকার বিদ্যুৎ খাতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু সেটি এখনো নিরবচ্ছিন্ন নয়। ব্যবসায়ীরাও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়ায় ক্যাপটিভ বা নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখছে। গ্রিডের বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত তা কারখানায় ব্যবহারে শিল্প মালিকরা এখনো অনাগ্রহী।
সার্বিক বিষয়ে বিদ্যুৎ খাতের নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মাদ হুসাইন জানান, উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিলে বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে নয়, বরং শিল্প খাতের সংযোগকে গুরুত্ব দিতে হবে। ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, সেটির সফলতা অনেকখানিই শিল্প-কারখানাগুলোকে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করার ওপর নির্ভর করছে। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচের বিষয়টি কীভাবে সমন্বয় করা যায় তা নিয়ে পাওয়ার সেল কাজ করছে। সরকারের লক্ষ্য শিল্প খাতে ট্যারিফ কমানোর পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। সেক্ষেত্রে ক্যাপটিভ গ্রাহকদের গ্রিডে আনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।