রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) দীর্ঘসময়ই লোকসান, দেনা ও ঋণভারে জর্জরিত ছিল। কিন্তু গত অর্ধযুগ ধরে প্রতিষ্ঠানটি লাভের মুখ দেখছে। ইতিমধ্যে বিপিসি অতীতের সকল ব্যাংক ঋণ, আন্তর্জাতিক অর্থ সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠানের দায়দেনা এবং সরকারের বকেয়া শুল্ক, কর ও ভ্যাটসমূহ সমুদয় পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে জ্বালানি তেল সরবরাহে প্রবৃদ্ধি ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। গত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বিপিসি ৩৭ হাজার ৪৫১ কোটি ২৪ লাখ টাকার মূল্যে পেট্রোলিয়াম পণ্য বিক্রয় করেছে। সরকারি কোষাগারে বিভিন্ন খাতে ১৪ হাজার ১২২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা প্রদান করেছে। অতীতের বিপুল লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখা সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি রেকর্ড। জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিপিসির সব ধরনের জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারি কোষাগার থেকে বর্তমানে বছরে ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। তবে অতীতে বিপিসির সরকারি বিভিন্ন ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার যে প্রক্রিয়া ছিল তার অবসান ঘটেছে। বর্তমানে শুধুমাত্র আইডিবির (ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আইটিএফসি (ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন) থেকে তেল আমদানিতে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করা হয়। বর্তমানে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবী থেকে মূলত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দরপত্রের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এমনকি চীন থেকেও তেল সরবরাহ করেছে। অতীতের দেনাদার থেকে বিপিসি বর্তমানে পাওনাদারও বটে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে বিপিসির পাওনা প্রায় ১৫শ’ কোটি টাকা। তাছাড়া বিপিসির কোষাগারে লাভের বড় অঙ্কের অর্থ জমা রয়েছে । যা সংস্থাটির বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের মেগাপ্রকল্পে বিনিয়োগের সক্ষমতা রাখে। এসব বিষয়ে সরকারের দূরদর্শিতার সুফল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে পরিশোধিত, অপরিশোধিতসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের চাহিদা বছরে প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। তবে করোনাজনিত কারণে গতবছর চাহিদার পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টন হ্রাস পায়। চাহিদায় অপরিশোধিত তেলের আমদানির পরিমাণ রয়েছে বছরে ১২ থেকে ১৩ লাখ মেট্রিক টন। ডিজেল আমদানি হয় ৪০ থেকে ৪২ লাখ মেট্রিক টন। অবশিষ্ট জ্বালানির মধ্যে রয়েছে জেট-এ-ওয়ান, অকটেন, ফার্নেস অয়েল ইত্যাদি। তাছাড়া বিপিসি নিয়ন্ত্রিত ইস্টার্ন রিফাইনারিতে (ইআরএল) উৎপাদিত ফার্নেস অয়েল অতীতে রফতানি করা হতো। বর্তমানে তা স্থানীয় পর্যায়ে বিপণন করা হয়ে থাকে। তবে মাঝে মধ্যে রফতানিও হচ্ছে। স্থানীয় উৎস থেকে জ্বালানি তেলের সার্বিক চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ যোগান হয়ে থাকে। অবশিষ্ট ৯২ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। ২০০৯ সালে দেশে সার্বিক জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল ৩৩ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন। যার বিপরীতে মজুদ ক্ষমতায় ছিল ৯ লাখ টন। ওই অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ১৩ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন। তার মধ্যে ডিজেলের ধারণ ক্ষমতা ৬ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন। যা দিয়ে স্বাভাবিক সময়ে দেশজুড়ে প্রায় ৪৫ দিনে চাহিদা পূরণ সম্ভব। ওই মুজদ সক্ষমতা ২০২৩ সালের মধ্যে ১৮ লাখ টনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, সরকার জ্বালানি খাতের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের কারণ বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের মজুদ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ১৩ লাখ টনেরও বেশি। ২০২৩ সালের মধ্যে আরো ৫ লাখ টন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। দেশের জ্বালানি তেল বিপণন ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে পরিকল্পিত পাইপ লাইনের মাধ্যমে তেল বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। কুতুবদিয়ার অদূরে গভীর সমুদ্রে নোঙ্গরকৃত জাহাজ থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য সিঙ্গেল মুরিং পাইপ লাইন স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য ২০৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম-ঢাকা পাইপ লাইন প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হচ্ছে। তাছাড়া ঢাকা হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে দেশী-বিদেশী উড়োজাহাজে নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্নভাবে জেট ফুয়েল সরবরাহে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত পিতলগঞ্জ-কুর্মিটোলা জেট ফুয়েল পাইপ লাইন প্রকল্পও বাস্তবায়ন হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কম সময়ে এবং কম খরচে জ্বালানি তেল সরবরাহের লক্ষ্যে ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপ লাইন নির্মিত হচ্ছে।
এদিকে বিপিসির পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী বিগত করোনাকালীন সময়ে জ্বালানি তেলের চাহিদা কিছুটা কম ছিল। বর্তমানে তা আবার বাড়ছে। বিপিসি তেলের চাহিদার যে প্রবৃদ্ধির হার নির্ণয় করেছে সে অনুযায়ী দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা হবে চলতি ২০২০-২০২১ সালে প্রায় ৬৬ লাখ মেট্রিক টন, ২০২১-২০২২ সালে ৬৮ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন, ২০২২-২০২৩ সালে ৭০ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন, ২০২৩-২০২৪ সালে ৭২ হাজার ৯৫ লাখ মেট্রিক টন, ২০২৪-২০২৫ সালে ৭৫ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন, ২০২৫-২০২৬ সালে ৭৮ লাখ মেট্রিক টন, ২০২৬-২০২৭ সালে ৮০ লাখ মেট্রিক টন, ২০২৭-২০২৮ সালে ৮২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন ও ২০২৮-২০২৯ সালে ৮৬ লাখ মেট্রিক টন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামে উর্ধ্বমুখী প্রবণতা রয়েছে। জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপিসিকে প্রতি ব্যারেলে ৭০ ডলারের ওপরের গেলেই লোকসান গুণতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে সর্বশেষ তেলের মূল্য বাড়িয়েছে ৬৮ ডলার। ওই হিসেবে তা বিপিসির জন্য অনেকাংশে সহায়ক। কিন্তু তার চেয়ে মূল্য বৃদ্ধি পেলেই লোকসান গুনতে হবে।
অন্যদিকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিপিসি নিয়ন্ত্রিত দেশের একমাত্র জ্বালানি তেলের পরিশোধনাগার চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ইধারএল’র দ্বিতীয় ইউনিট প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। সিটি প্রতিষ্ঠা হলে রিফাইনারি পরিশোধনের ক্ষমতা আরো ৩০ লাখ টন বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে রিফাইনারিতে সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৩ লাখ টন ক্রুড অয়েল পরিশোধন হয়ে থাকে। কিন্তু জ্বালানি তেলের চাহিদা যেখানে বর্তমানে প্রায় ৬৫ লাখ মেট্রিক টন, সেক্ষেত্রে অবশিষ্ট পরিমাণ পরিশোধিত আকারে আমদানি করতে হয়। বিপিসি নিয়ন্ত্রিত তিনটি মার্কেটিং কোম্পানি যথাক্রমে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানির মাধ্যমে জ্বালানি তেল বিপণন হয়ে থাকে। ওই তেল কোম্পানিগুলো দীর্ঘ সময় জুড়েই লাভজনক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিপিসি ছিল একটি ঋণ ও দেনা-দায়গ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। তবে বর্তমান সরকারের উন্নয়নমুখী চিন্তা-ভাবনার সুফল হিসেবে ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি লাভের মুখ দেখতে শুরু করে এবং তা এখন অব্যাহতভাবে চলছে। গত ২০১৮-২০১৯ সালে বিপিসি নিট মুনাফা করেছে ৩ হাজার ৯৮০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০১৯-২০২০ সালে মুনাফা করেছে ৫ হাজার ২২৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
এ প্রসঙ্গে বিপিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিপিসিকে দক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া হাতে নেয়া হলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষ করে বিপিসির অর্গানোগ্রাম পরিবর্তনে কয়েক দফা সুপারিশ থাকলেও তা বছরের পর বছর মন্ত্রণালয়ে ঝুলে রয়েছে। সংস্থাটির বিভিন্ন উইংয়ের নেতৃত্বে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। যে কারণে বিপিসিকে আরো অধিকতর লাভজনক করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ওই প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের সর্বশেষ অর্গানোগ্রামের যে সুপারিশ রয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে বিপিসি ক্রমাগত মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে আরো বহু দূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।