দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডিগ্রি কলেজগুলোতে খোলা হচ্ছে অনার্স কোর্স। আর যত্রতত্র অনার্স খোলার নেপথ্যে রয়েছে নিয়োগ বাণিজ্য। অভিযোগ রয়েছে- নামমাত্র অনুমতি নিয়ে অনার্স কোর্সের নামে কলেজগুলো নিয়োগ বাণিজ্য করছে। তাতে ডিগ্রি কোর্সের শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি মানহীন কলেজগুলোতে অধিক খরচে শিক্ষার্থীদের পড়তে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যন্ত এলাকা, মফস্বল ও উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত ভৌত অবকাঠামো, সুপরিসর শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার ও সেমিনার কক্ষ এবং প্রতিটি বিষয়ে অন্তত ৭ জন শিক্ষক না থাকলে কোনোভাবেই আর অনার্স খোলার অনুমতি না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আর সরকারের এ নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা ইতিমধ্যে চিঠি দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অনার্স চালুর ক্ষেত্রে দেশের বেসরকারি কলেজগুলোতে এক ধরনের দ্বৈত শাসন বিরাজ করছে। অনার্সের অধিভুক্তি ও কোর্স-কারিকুলাম অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অনার্স কোর্স চালু করতে গেলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিটি বিষয়ে অন্তত ৭ জন শিক্ষক থাকার শর্ত দেয়া হয়। কিন্তু শিক্ষকের বেতন-ভাতা দেয়ার কোনো দায়দায়িত্ব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। সংশ্নিষ্ট কলেজ কর্তৃপক্ষকে শিক্ষকদেও বেতন-ভাতা দিতে হয়। আর অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ের কলেজ শিক্ষকদের সরকারিভাবে এমপিওভুক্ত করা হয় না। ওই কারণে কলেজগুলো কাগজে-কলমে শিক্ষক নিয়োগ দেখালেও বাস্তবে প্রতিটি বিষয়ে ৭ জন শিক্ষক থাকে না। ফলে শিক্ষার মান পড়ে যাচ্ছে। বহু কলেজেই অনার্স পর্যায়ে পূর্ণকালীন ৭ জন শিক্ষক নেই। বরং খ-কালীন শিক্ষক দিয়ে ওসব কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তাতে শিক্ষার্থীরা কোচিং ও নোট-গাইডমুখী হয়ে পড়ছে।
১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত সারাদেশের ৮৫৭টি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। তার মধ্যে সরকারি কলেজ ২৯৯টি এবং উপজেলা পর্যায়ে সদ্য জাতীয়করণকৃত কলেজ ৩০২টি। তাছাড়া ২৫৬টি বেসরকারি কলেজ রয়েছে। ওসব বেসরকারি কলেজে প্রায় ৮ লাখ ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। সরকারি কলেজে অনার্সে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন মাত্র ২৫ টাকা হলেও বেসরকারি কলেজে তা ৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
সূত্র জানায়, বেসরকারি কলেজের অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে পাঠদানে নিয়োজিত শিক্ষকরা সরকারি বেতন-ভাতা পান না। আবার এমপিওভুক্ত হতে পারেন না। কোনো কোনো বেসরকারি কলেজে শিক্ষকদের নামমাত্র আড়াই হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা সম্মানী দেয়। অনেক কলেজ সেটাও আবার প্রতিমাসে দেয় না। তাছাড়া শিক্ষক নিয়োগে অনেক ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও সরকারের আইনকে তোয়াক্কা করে না। এনটিআরসিএ'র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের বিধান থাকলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনেক ক্ষেত্রেই তা মানে না। এর মূল কারণ কলেজ কর্তৃপক্ষের নিয়োগ বাণিজ্য এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন বাণিজ্য।
কোনো বিষয়ে অনার্স কোর্স অনুমোদনের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ধাপে ধাপে কলেজ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একের পর এক কলেজে অনার্স খোলার অনুমোদন দিলেও শিক্ষকদের কোনো দায়দায়িত্ব নিচ্ছে না। বরং শিক্ষকদের বেতনের কথা না ভেবেই যত্রতত্র বেসরকারি কলেজে অনার্স কোর্স চালু করা হচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেসরকারি অনার্স কলেজগুলোতে শিক্ষকদের দুর্দশার কথা জানার পরও বেতনের দায়ভার কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। অথচ নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের বেতনের পথ তৈরির কথা ভাবা হয় না।
ফলে কলেজ কর্তৃপক্ষ বেপরোয়াভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ওই শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা না হলে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান থাকছে না। অভিযোগ রয়েছে, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র কলেজ প্রতিষ্ঠা বা অনার্স ও ডিগ্রি (পাস কোর্স) খোলার অনুমতি দেয়া হয়। লাগামহীনভাবে রাতারাতি স্নাতক পর্যায়ের কলেজ গজানোর ফলে ওসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা দিতে প্রতি বছরেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোটি কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে। অথচ উচ্চশিক্ষা প্রদানের জন্য যে মানের শিক্ষক নিয়োগ করার কথা, বেশিরভাগ কলেজে তা কখনোই অনুসরণ করা হয় না। ফলে উচ্চশিক্ষার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সূত্র আরো জানায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ষষ্ঠ বৈঠকে যত্রতত্র অনার্স কোর্স খোলার তীব্র সমালোচনা করা হয়। সভায় বলা হয়, উপযুক্ত শিক্ষক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ছাড়াই দেদারছে উপজেলা ও মফস্বল এলাকার কলেজগুলোতে ৪ বছরের স্নাতক (অনার্স) শ্রেণির কোর্স চালুর অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। আবার অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুর জন্য এমপিওভুক্ত না করার শর্তে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে ওই শিক্ষকরা আন্দোলনে নামছেন এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষকরা মামলা করে নিজেদের পক্ষে রায়ও পাচ্ছে। তাদের এমপিওভুক্তিসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংসদীয় কমিটি যত্রতত্র অনার্স কোর্স চালুর অনুমতি সীমিত করার সুপারিশ করেছে। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশের আলোকে যত্রতত্র অনার্স কোর্স চালু না করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কেবল বেসরকারি কলেজ নয়, সরকারি কলেজগুলোতেও ভবিষ্যতে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না থাকলে নতুন কোনো বিষয়ে অনার্স চালুর অনুমতি দেয়া হবে না।
এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠান অধিভুক্তির ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যা, ৩ বছরের ফলাফল, অবকাঠামো, পাঠাগার ও বই ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত পূরণ করতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হয়নি। বরং রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা বিশেষভাবে ম্যানেজ হয়ে অনেক কলেজকে অধিভুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া শর্তসাপেক্ষে অনার্স কোর্স চালুর অনুমোদন দেয়ার পর কলেজগুলোকে তদারকি ও অধিভুক্তি নবায়নের নিয়ম রয়েছে। তবে বাস্তবে একবার অধিভুক্তির পর দ্বিতীয়বার কোনো কলেজ পরিদর্শনের নজির নেই বললেই চলে। ফলে তদারকির অভাবে অধিকাংশ কলেজই ইচ্ছামতো চলছে। শুধু তাই নয়, অনার্স কোর্সের অনুমতি পাওয়ার পর কলেজগুলো 'বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ' নামকরণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালুর বিদ্যমান নীতিমালা বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ জানান, সরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালুর অনুমতি না দিলে সেখানে শিক্ষক পদায়ন করা হয় না। তাই অনেক সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে অনুমোদন দেয়া হয়। তবে বেসরকারি কলেজে অনার্স কোর্স চালুর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যেসব কাগজপত্র সবররাহ ও শর্ত পূরণের অঙ্গীকার করা হয়, পরে তা আর মানা হয় না।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, দেশের প্রতিটি জেলায় সরকারের একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। সুতরাং উপজেলা ও মফস্বল এলাকার কলেজে লাগামহীনভাবে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। পাশাপাশি বিভিন্ন কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স খোলার অনুমতি প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান, প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ফলে ওসব প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রতিবছর প্রওচুর শিক্ষিত বেকার তৈরি হচ্ছে। যা জাতির জন্য বড় বোঝা। এ সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।