দেশের পরিবহন ও সেচ খাতে জ¦ালানির বিকল্প হিসাবে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ায় কমছে ডিজেল আমদানি পরিমাণ। গত বছর যেখানে ডিজেল আমদানি হয়েছে ৪৬ লাখ টন, এবার কমে দাঁড়াবে ৩২ লাখ টন। ১৪ লাখ টন ডিজেলের আমদানি কমায় অন্তত প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। বিদেশ থেকে প্রতি জাহাজে ৩০ হাজার টন তেল আসে। আর ওই তেল আনতে খরচ হয় ১৮০ কোটি টাকা। ওই হিসাব ধরে ১৪ লাখ টনের জন্য প্রয়োজন হয় আট হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এখন ওই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আর ডিজেল আমদানির জন্য প্রয়োজন হবে না। পাশাপাশি দেশের পরিবেশও হবে নির্মল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের কথা চিন্তা করে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো ডিজেল ব্যবহার কমাচ্ছে। বর্তমানে এদেশে ডিজেলের ব্যবহার কমার যে ধারা তৈরি হয়েছে তাতে পরিবেশগত দিক দিয়ে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। জ¦ালানি বিভাগ এবং বিশেষজ্ঞদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অতীতে গ্যাসের সঙ্কটের কারণে ২০১৩ সাল থেকে দেশে দ্বৈত জ্বালানির বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। সেগুলো ডিজেলে চালানো হতো। কিন্তু গত বছর এলএনজি আনার পর থেকে ওসব কেন্দ্র গ্যাসে চলছে। ফলে বিপুল পরিমাণ ডিজেল সাশ্রয় হয়েছে। যা দেশের ডিজেল ব্যবহার কমার একটি বড় কারণ। তাছাড়া এক সময় গ্রামে পরিবহনে যে ডিজেল ব্যবহার হতো, এখন সেখানে ইলেক্ট্রিক যান এসেছে। তাতেও ডিজেলের চাহিদা কমেছে। তাছাড়া দেশের নতুন নতুন এলাকা বিদ্যুতায়িত হচ্ছে। ফলে সেচ কাজেও ব্যাপকভাবে বিদ্যুতের ব্যবহার হচ্ছে। যা দেশে ডিজেল আমদানি কমার আরেকটি কারণ। তবে ডিজেল আমদানিতে অর্থের সাশ্রয় হলেও এলএনজি আমদানিতে তা ব্যয় হচ্ছে। অবশ্য জ্বালানির বহুমুখীকরণের ফলে কিছুটা অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে। তাছাড়া অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির জ্বালানি হওয়াতে এলএনজিতে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে না বললেই চলে।
সূত্র জানায়, সরকার ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রাখার কারণেও দেশে ডিজেলের ব্যবহার কমেছে। দেশে ডিজেলে এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ২৭ টাকা ২১ পয়সা। এর মধ্যে জ্বালানি খরচই সর্বোচ্চ প্রয়োজন পড়ে ১৪ টাকা ৯২ পয়সা। কিন্তু অন্য তরল জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তার অর্ধেক ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ফার্নেস অয়েল দিয়ে চালানো কেন্দ্রগুলো ১৩ টাকা ৬২ পয়সায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। মূলত ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে বেশি আর্থিক ক্ষতির কারণ মনে করে বিদ্যমান কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ক্রমান্বয়ে ডিজেল ইঞ্জিনের বদলে ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন ব্যবহার করছে। ইউরোপের অনেক দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ডিজেল ইঞ্জিনের বদলে ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন ব্যবহারের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে এদেশে এখনই ওই যাত্রা শুরু করা কঠিন। এখন নতুন আমদানি করা গাড়িগুলোর ক্ষেত্রে সরকার হাইব্রিড প্রযুক্তিতে কর ছাড় দিচ্ছে। হাইব্রিড গাড়ি ব্যাটারি এবং তরল জ্বালানিতে চলার কারণে সাশ্রয়ী। ফলে তরল জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করছে। তবে এদেশের গ্রামীণ জনপদে বিদ্যুৎ চালিত যানের বিস্তার ঘটলেও শহর পিছিয়ে রয়েছে। তাছাড়া বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশেষ করে সৌরশক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। আর গাড়ির জ্বালানিতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পাশাপাশি এলপিজিও ব্যবহার করা যেতে পারে। যা ডিজেলের চেয়ে দামে কম এবং পরিবেশবান্ধবও।
এদিকে জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজেলে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা মতে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আয়ু কমছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই দূষণ সবচেয়ে বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। এর ক্ষতিকর প্রভাবে বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বর্তমানে দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রাজধানী ঢাকা। এই দূষণের একটি বড় অংশ হয় ডিজেলের কারণে। ডিজেল পোড়ালে যেসব বস্তুকণা পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, জৈব বিষ-পলিনিউক্লিয়ার এ্যারোমেটিক্স। চিকিৎসকরা বলছেন, ক্ষুদাতিক্ষুদ্র ওসব কণা ফুসফুসের কোষের ভেতরেও ঢুকে যেতে পারে। ফলে সাধারণ মানুষের অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট থাকলে তা আরো বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। আর দীর্ঘদিন এই দূষণের শিকার হলে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন জানান, ডিজেলের ব্যবহার কমা এদেশের পরিবেশের জন্য একটি সুখবর। এদেশে মধ্যম মানের ডিজেল কেনা। কারণ একেবারে কম সালফারযুক্ত ডিজেলের দাম অনেক বেশি। যার ব্যয় বহন করা কঠিন। মূলত যত কম ডিজেল পোড়ানো হবে, ততোই বায়ুর দূষণ কম হবে।
অন্যদিকে ডিজেল আমদানি কমার প্রসঙ্গে বিপিসি চেয়ারম্যান মোঃ সামছুর রহমান জানান, ডিজেল প্রধানত ব্যবহার হয় পরিবহন এবং সেচে। কিন্তু দুই জায়গাতে মূলত জ্বালানি হিসেবে ডিজেলের ব্যবহার কমেছে। পাশাপাশি সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ডিজেলের ব্যবহার অনেকটাই বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে দেশে ডিজেলের চাহিদা কমছে।