সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে এবার বিদ্যুতের দাম সবচেয়ে বেশি হারে নির্ধারিত হতে যাচ্ছে। মূলত আমদানিনির্ভর এবং ব্যয়বহুল উৎস জ্বালানি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ব্যবহার বাড়ার কারণেই বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। তাছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী এবং অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদন খরচের কয়লানির্ভর বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা মূল্য বৃদ্ধিতেই সমাধান খোঁজা হচ্ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এবং ক্যাব সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে পাইকারি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী একমাত্র সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি নিজ বিতরণ এলাকার জন্য খুচরায়ও মূল্যবৃদ্ধি চায়। কারণ বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত একমাত্র কোম্পানি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) সঞ্চালন মাশুল বৃদ্ধির জন্য চিঠি দিয়েছে। পাশাপাশি বিতরণকারী অন্য পাঁচটি সংস্থা-কোম্পানিও বিদ্যুতের খুচরা মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। এবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির হারও গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়তে পারে। আর বর্ধিত ওই মূল্যহার আগামী বছরের মার্চের মধ্যেই বাস্তবায়িত হবে।
সূত্র জানায়, জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আগামী ২৮ নভেম্বর পাইকারি এবং সঞ্চালন মূল্যহার পরিবর্তন প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি আয়োজন করেছে। তারপর ১ ডিসেম্বর পিডিবি ও নেসকোর, ২ ডিসেম্বর ঢাকার দুই বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসি ও ডেসকোর এবং ৩ ডিসেম্বর ওজোপাডিকো ও পল্লী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুৎ বলেছে, পাইকারি দাম না বাড়লে বিদ্যুতের খুচরা দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। আর বিতরণ কোম্পানিগুলোর মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, এলএনজি আমদানি ও ব্যবহার বৃদ্ধি, পরিচালন ও জনবল বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি, যন্ত্রপাতির দাম বৃদ্ধি এবং আপগ্রেডেশন খরচ বাড়ায় বিদ্যুতের খুচরা মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, দেশে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ৪৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ বিদ্যুৎ বিতরণ করে পল্লী বিদ্যুৎ (আরইবি)। তাছাড়া পিডিবি ১৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ডিপিডিসি ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ডেসকো ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, নেসকো ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং ওজোপাডিকো ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ বিতরণ করে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে পাইকারি বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ায় সরকার। এর আগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের দাম ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল।
এদিকে ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর মতে, বিদ্যুৎ খাতের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ হলে এবং কিছু বেসরকারি উৎপাদককে অন্যায্য সুবিধা দেয়া বন্ধ করলেই বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে না। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থেকে কম খরচে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের বড়ো প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলে বিদ্যুতের মূল্য বরং কমানো যায়। এ প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে বেসরকারি প্ল্যাটফরম কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম জানান, কোম্পানিগুলোর পরিচালন ব্যয় ও দুর্নীতি কমানোর অনেকগুলো পথ রয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়ন করলে মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু কৃত্রিমভাবে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি দেখিয়ে খুচরা দাম বাড়নোর চেষ্টা চলছে। এটি অন্যায় ও অন্যায্য। শুনানিতে এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরা হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিইআরসির চেয়ারম্যান ও সাবেক বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম জানান, কোম্পানিগুলো বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। আবেদনগুলোর যৌক্তিকতা মূল্যায়ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে গণশুনানি আয়োজন করা হয়েছে। যৌক্তিকতা প্রমাণিত হলে মূল্যহার সমন্বয় করা হবে।