নওগাঁর পত্নীতলায় ব্যবসায়ী ও ছাত্র সুমন হত্যার প্রতিবাদে দিনভর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে পড়েছিল উপজেলার পৌর সদর নজিপুর বাসষ্ট্যান্ড। সুমনের সহপাঠিমহ নজিপুর সরকারি কলেজের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজ, নজিপুর বাসষ্ট্যান্ড বণিক কমিটি পৃথক পৃথক ভাবে এ সকল বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করে। সকাল থেকেই হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে এবং হত্যার সুষ্ঠ তদন্ত ও হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জোর দাবী জানান। সুমনের ব্যবসায়ীক সহকর্মীরা দুপুর ১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত দোকানপাট বন্ধ রেখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবী জানান। দুপুরে পত্নীতলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আলিমুজ্জামান ও থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ এনায়েতুর রহমান বিক্ষোভ স্থলে ছুটে আসেন এবং বিক্ষোভকারীদের দাবীর প্রতি একাত্বতা ঘোষণা করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।
এদিকে ব্যবসায়ী সুমন হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর বোন মৌসুমী সুদের ব্যবসায়ী বুলবুল ইসলামসহ অজ্ঞাতনামা আরো ৯/১০জনকে আসামী করে ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ৩০২/৩৭৯/৩৪ ধারায় পত্নীতলা থানায় গত ১৮/১১/২০২৪ তারিখে মামলা দায়ের করেছেন। যার মামলা নং-১১.
থানায় প্রদত্ত এজাহার সূত্রে জানা গেছে, নিহত সুমন (২৪) বাড়ি মহাদেবপুর উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের বিলছাড়া গ্রামে। সে মৃত ময়েন উদ্দিন এর ছেলে। নজিপুর বাসষ্ট্যান্ড মসজিদ মার্কেটে সুমন কম্পিউটার এন্ড ফটোষ্ট্যাট নামে তাঁর একটি দোকান আছে। সুমনের দোকানের দক্ষিণ পাশে আসামী বুলবুল ইসলাম এর বুলবুল টেলিকম নামক দোকান আছে। আসামী বুলবুল ইসলাম ও সুমনের মধ্যে পূর্ব থেকে টাকা পয়সার লেনদেন নিয়ে বিরোধ ছিলো। সুমন আসামী বুলবুল এর নিকট থেকে ৭০হাজার টাকা ধার হিসাবে গ্রহণ করে। টাকা প্রদানের সময় আসামী সুমনের নিকট থেকে স্বাক্ষরিত ফাঁকা ষ্ট্যাম্প ও চেকের পাতা নেয়। সুমন উক্ত টাকা গ্রহণের পর আসামী বুলবুলকে প্রতিদিন ১হাজার টাকার বিনিময়ে ২০টাকা লভাংশ প্রদান করতো। এভাবে সুমন আসামীকে ১লাখ ৪০হাজার টাকা প্রদান করেছে। আসামী বুলবুল সুমনের সরলতার সুযোগ নিয়ে ফাঁকা ষ্ট্যাম্প ও চেকের ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে ৭লাখ টাকা নিয়েছে। এরপরও আসামী বুলবুল ইসলাম সুমনের নিকট থেকে ৮লাখ ৫০হাজার টাকা দাবী করতে থাকে। আসামী উক্ত টাকার জন্য সুমনের উপর বার বার চাপ প্রয়োগ করতে থাকে এবং টাকা না দিলে মামলা করবে বা প্রাণে মেরে ফেলবে বলেও হুমকি দিতে থাকে। সুমন মান সম্মানের কথা চিন্তা করে আসামী বুলবুলকে চাহিদা মতো টাকা দিতে রাজি হয়।
গত ১৪/১১/২৪ তারিখে আসামী বুলবুল ফোন করে সুমনকে টাকার জন্য চাপ দেয়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয় এবং আসামী সুমনকে পুনরায় হত্যার হুমকি দেয়। এ সময় সুমন আসামী বুলবুল ইসলামকে ১৭/১১/২৪ তারিখে টাকা দিবে বলে জানায়। ১৭/১১/২৪ তারিখে আসামীকে দেওয়ার জন্য সুমন মহাদেবপুর হতে ১০লাখ টাকা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। এরপর সুমনের সাথে পরিবারের কাহারো যোগাযোগ হয়নি। সুমন ১০লাখ টাকা নিয়ে ১৭/১১/২৪ তারিখে রাত আনুমানিক ১০.১৫ মিনিটে পত্নীতলা থানাধীন নাদৌড় মোড়ে সিএনজি হতে নেমে বুঝতে পারে যে, কিছু লোক তাকে অনুসরণ করছে। সুমন তখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে নাদৌড় গ্রামের দিকে পালাতে থাকে এবং পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। এ সময় সুমন তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বের করে রাত সাড়ে ১০টায় ফেসবুক লাইভে এসে ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ দেয় যে, আসামী বুলবুলসহ অজ্ঞাতনামা ৯/১০জন পূর্ব শত্রুতার জের ধরে হাতে লাঠিসোটা, ধারালো চাকু নিয়ে তাকে (সুমনকে) হত্যার উদ্দেশ্যে খোঁজাখুজি করছে এবং তাঁর প্রাণ নাশের আশংকা আছে মর্মে ভিডিওতে উল্লেখ করে। পরবর্তিতে সুমন বাঁচার তাগিদে তার চাচাতো ভাই রুবেল হোসেনকে ম্যাসেঞ্জারে কল দিয়ে বলে বুলবুল আমাকে মেরে ফেলছে আমাকে বাঁচাও। সংবাদ পেয়ে একই গ্রামের সুমনের চাচাতো ভাই রুবেল, নাইম, রুহুল আমিন রনি, রহিমাপুর গ্রামের আব্দুল লতিফের ছেলে আরমান হোসেন মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত নাদৌড়গামী পাকা রাস্তায় আসে এবং রাত আনুমানিক ১০.৫০ মিনিটে নাদৌড় নাপিত পুকুর হতে ৩০০গজ পূর্ব দিকে গোবিন্দ্র চন্দ্র শীল এর ধানক্ষেত সংলগ্ন পাকা রাস্তার উপর একটি কাঁঠাল গাছের সহিত সুমনকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। এ সময় তাঁরা কাঁঠাল গাছের নীচে ধানক্ষেতে একটি ছুরি ও দেখতে পায়। স্বাক্ষীগণ সুমনকে দ্রুত গাছ থেকে নামিয়ে পত্নীতলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার সুমনকে পরীক্ষা করে রাত ১১.১০ মিনিটে মৃত ঘোষণা করে। আসামীগণ পূর্বশত্রুতার জের ধরে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক পরস্পর যোগসাজসে সুমনকে ১৭/১১/২৪ তারিখে রাত আনুমানিক ১০.৩০ হতে ১০.৫০ মিনিটের মধ্যে হত্যা করে লাশ গাছের সাথে ঝুলে রাখে এবং তার সাথে থাকা নগদ ১০লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। সুমনের মৃত্যুর বিষয়ে স্বাক্ষীরা থানায় সংবাদ দিলে পুলিশ হাসপাতালে এসে নিহত সুমনের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করে এবং লাশ ময়না তদন্তের জন্য নওগাঁয় প্রেরণ করে।
এদিকে নিহত সুমনের নামাজের জানাযা ১৮/১১/২৪ তারিখ রাত ৮টায় সম্পন্ন হয়েছে এবং জানাযা শেষে নিজ গ্রাম বিলছাড়ায় দাফন করা হয়েছে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামী পলাতক থাকায় তাঁকে গ্রেফতারের প্রচেষ্টা চলছে বলে পত্নীতলা থানা সূত্রে জানা গেছে।
ছবি ক্যাপশন: নওগাঁর পত্নীতলায় সুমন হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবীতে মঙ্গলবার দিনভর নজিপুর বাসষ্ট্যান্ডে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।