ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপাঁচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহর সাথে মতবিনিময় করেছেন। সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তনে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
কুরআন ও বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠের ওই মতবিনিময় সভা শুরু হয়। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশনা এবং জুলাই বিপ্লবে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন ও দোয়া-মোনাজাত করা হয়। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সম্প্রতি প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা প্রফেসর ড. ছিদ্দিকুর রহমান আশ্রাফী। অনুষ্ঠানটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক সায়েম আহমেদ ও সাদিয়া মাহমুদা মিমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এস এম সুইট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য ৪৬ দফা সংস্কার প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
জানা যায়, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যহীন, আধুনিক এবং মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে। প্রস্তাবনা দাবিগুলোর মূল লক্ষ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। শিক্ষার্থীদের দাবি, এই প্রস্তাবনাগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় একটি বৈষম্যহীন, আধুনিক ও গবেষণামুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হবে।
প্রধান দাবি: লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ
শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। ছাত্র রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির কারণে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারীরা। প্রস্তাবনায় দাবি করা হয়েছে, দলীয় রাজনীতি বন্ধের জন্য দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
শিক্ষা কার্যক্রমের আধুনিকায়ন
শিক্ষার্থীরা শিক্ষা কার্যক্রমকে উন্নত ও আধুনিক করার জন্য লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এলএমএস) চালুর প্রস্তাব করেছেন। এর মাধ্যমে শিক্ষাকার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে বলে তারা মনে করেন। সেশনজট সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারের বাধ্যতামূলক অনুসরণ এবং গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাও তারা তুলে ধরেছেন। শিক্ষকদের নিয়মিত ক্লাস নেয়ার বাধ্যবাধকতাও নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেছে শিক্ষার্থীরা।
আবাসন সংকট নিরসনের দাবি
শিক্ষার্থীদের ৪৬ দফা প্রস্তাবনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকট নিরসনের বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে। তারা দাবি করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের রোডম্যাপ প্রণয়ন করতে হবে এবং মেধার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। নতুন হল নির্মাণের মাধ্যমে আবাসন সংকট সমাধানের বিষয়টি তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
প্রযুক্তি সেবা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন
প্রস্তাবনায় শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও হলের রিডিং রুম আধুনিকায়নের পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি সেবার মান উন্নয়নের দাবিও জানিয়েছেন। হলগুলোতে মানসম্মত ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার আধুনিকায়ন এবং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর সেবার মান বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়েছে।
নিরাপত্তা ও ক্যাম্পাস সংস্কার
শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অনুমোদনবিহীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, ক্যাম্পাসকে মাদক ও র্যাগিং মুক্ত রাখা এবং বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবনা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ করার দাবিও তারা জানিয়েছেন। এছাড়া, শিক্ষার্থী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে তারা।
শিক্ষার্থীদের দাবি, এই ৪৬ দফা প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। তারা মনে করে, এই সংস্কারগুলি কার্যকর হলে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় একটি আধুনিক, বৈষম্যহীন এবং গবেষণামুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, যা শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের গ্র্যাজুয়েট হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এস এম সুইট বলেন, “আমাদের ৪৬ দফা সংস্কার প্রস্তাবনার মাধ্যমে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চাইছে। যদি এই প্রস্তাবনাগুলি বাস্তবায়ন করা হয়, তবে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিবেশে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন বয়ে আনতে সক্ষম হবে।”
এ বিষয়ে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাঁচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ মতবিনিময় সভায় বলেন, “শহীদদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আজকের বাংলাদেশ পেয়েছি, এবং আমি এখানকার উপাঁচার্য হয়েছি। আমার কাজ হবে সেই রক্তের ঋণ পরিশোধ করা। এজন্য সবাইকে একসাথে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবিগুলো যৌক্তিক, এগুলো পেয়ে আমার ক্যাম্পাস সংস্কারের কাজ সহজ হয়েছে, এবং নতুন করে ভাবতে হবে না। আমি দায়িত্ব নিয়েছি তোমাদের জন্য কাজ করতে, এবং তোমাদের আশাহত করবো না। আমি প্রতিদিন তোমাদের সাথে কথা বলে সংস্কার করতে চাই।”