অজপাড়াগাঁয়ের একটি গ্রামের নাম বিন্না। গ্রামটিকে এখন সবাই চেনে ‘ক্রিকেট ব্যাটের গ্রাম’ হিসেবে। উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের অবহেলিত এ জনপদটিতে আধুনিকতার কোনো ছাঁপ পড়েনি এখনও। তবুও বসে নাই কোনো সংগ্রামী নারী-পুরুষ। আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া তেমন না লাগলেও এ গ্রামকে অনেকেই চেনেন ‘‘ব্যাট কালামের’’ গ্রাম হিসেবেও। ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করে হাজারো কারিগরের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে এখানের হাজারও মানুষের। স্বরুপকাঠির তৈরি ক্রিকেট ব্যাট যাচ্ছে আবার বিশ্বের মাটিতেও।
কয়েক যুগ থেকেই কাঠ ব্যবসা সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে ব্যাপক পরিচিত নেছারাবাদের ইন্দেরহাট সহ বিন্না, জিলবাড়ি, চামি, ডুবি, উড়িবুনিয়া, ও বলদিয়া সহ অন্তত আরও পনেরটি গ্রাম। আর এসব নিভৃত গ্রামেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কারখানা। বর্তমানে কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় অর্ধ শতাধিকেরও বেশি। ফলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার শ্রমজীবী মানুষ। প্রতিদিন এসব গ্রাম থেকে শত শত ব্যাট তৈরি করে পাঠানো হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। দেশের শতভাগ চাহিদা পূরণের উন্নত মানের ক্রিকেট ব্যাট যাচ্ছে বিদেশেও।
দেশের যে হাজার হাজার দেশীয় ব্যাটের ব্যবহার হয় তার জনক হচ্ছেন নেছারাবাদের বেলুয়া নদের তীরে অবস্থিত উড়িবুনিয়ার অখ্যাত ছুতোর পরিবারে জন্ম নেয়া অতি দরিদ্র মৃত আবদুল লতিফ মিয়া। তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে কাজের সন্ধানে ঢাকায় গিয়ে কাঠ মিস্ত্রী হিসেবে জুরাইনের ‘খেলার সাথি’ নামে একটি কাঠের কারখানায় কাজ পান। আর সেখান থেকেই বিভিন্ন খেলার সামগ্রী যেমন -প্রাইজ শিল্ড, ক্রিকেট ব্যাট, ক্যারম বোর্ড ও হকি স্টিক মেরামতের কাজ করতেন। এরপর থেকেই লতিফের মাথায় চেপে বসে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির নেশা। বিদেশি ব্যাট তৈরির সমমানের স্থানীয় গাছের সন্ধান করতে থাকেন তিনি। খুঁজে বের করেন দেবদারু, কদম ও বাইনসহ নানা প্রজাতির কাঠ দিয়ে শুরু করেন ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কাজ। সস্তায় ব্যাট তৈরির টার্গেট নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে আসেন নিজ গ্রামে। নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন ব্যাট তৈরির কারখানা। ঢাকার বাইরে নেছারাবাদে এটাই ব্যাট তৈরির আদি কারখানা। লতিফ মিয়া কারখানাকে ভিত্তি করে ঢাকায় আমদানি কৃত ক্রিকেট ব্যাটের পাশাপাশি দোকানে স্থান পায় নেছারাবাদের ক্রিকেট ব্যাট। এভাবেই রপ্তানি সুবিধা বৃদ্ধি পেতে থাকায় বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠে ব্যাটের কারখানা। লতিফের সহকর্মী কালাম নিজ বাড়িতে যে বিরাট কারখানা তৈরি করেছেন তার সৌরভ ছড়িয়ে পরে বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব পরিম-লে।
ব্যাট তৈরির কারিগর আবুল কালামের স্ত্রী নিলুফা ইয়াসমিন ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র ঋণ সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নিয়েছিলেন স্বামীর ক্রিকেট কারখানার অন্যতম মালিক হিসেবে। কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে নিলুফা যোগদেন। ‘পদক্ষেপ’ নামের একটি এনজিওর ক্ষুদ্র ঋণ গ্রুপের সফল শিল্প উদ্যোক্তা নিলুফা। ওই বছরেই নিলুফা ঢাকায় সিটি গ্রুপ ক্ষুদ্রউদ্যোক্তা পুরস্কার পান। কানাডার সম্মেলন থেকে অন্যান্য পুরস্কার ছাড়াও নিলুফাকে ৪ হাজার মার্কিন ডলার নগদ অর্থ উপহার হিসেবে দেয়া হয়। বাংলাদেশি ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা সমমানের এ উপহারের অর্থ দিয়ে কালাম-নিলুফা দম্পতি জমি কিনে বাড়ি ও ব্যাট কারখানা গড়ে তুলেছেন। উৎপাদনকারী স্থানীয় ব্যাট কারিগররা জানান, প্রকারভেদে বিভিন্ন গাছের ব্যাট ৭৫ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রয় করছেন। অপরদিকে, ঘষামাজা ও লেবেল লাগানো প্রতিটি ব্যাট পাইকারি রেটে ঢাকায় বিক্রয় করা হয় ছোট ব্যাট ৩শ’ থেকে ৬শ’৫০ আবার এর চেয়ে একটু উন্নত মানের ব্যাট থেকে ৭শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। এপ্যারে নেছারাবাদ বিসিক ম্যানেজার মো. মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা বিসিক শিল্প নগরী ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে থাকে। এখানকার ব্যাট দেশের চাহিদা পূরণ করে দেশের বাইরেও যাচ্ছে।
নেছারাবাদের ব্যাট শিল্প এবং অত্র শিল্পের কারিগরদেরকে স্বীয় পেশায় টিকিয়ে রাখতে হলে এ খাতে পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধাসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, কাঁচা মালের মূল্য কমানোসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে পেশার মান উন্নত ও ব্যবসায়ীরা লাভের মুখ দেখত বলে মনে করছেন তারা।