কালীগঞ্জ উপজেলার আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিক ঠান্ডু আনুষ্ঠানিকভাবে উপজেলা পরিষদ থেকে বিদায় নিলেন। তিনবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করলেও চলতি বছরের ৮ মে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন নাই। ঐ নির্বাচনে উপজেলার চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন শিবলী নোমানী। বুধবার বেলা ১২ টায় উপজেলা পরিষদ সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত মাসিক সাধারণ সভায় কোন প্রকার আয়োজন ছাড়াই বিদায় নেন বর্ষীয়ার এই নেতা। এ সময় নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী ছাড়া ও উপস্থিত ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যানগণ। উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত জাহান, ইউপি চেয়ারম্যানগন এবং উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ। উপজেলা পরিষদ থেকে বিদায় নিলেও রাজনীতি থেকে এখনই বিদায় নিচ্ছেন না উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীন এই নেতা। কালীগঞ্জ উপজেলার স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ পিরোজপুর গ্রামের এই কৃতী সন্তান মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন ১৯৫০ সালে। মৃত আবদুল গনিশাহ ও মৃত রাবেয়া খাতুন দম্পতির সন্তান জাহাঙ্গীর সিদ্দিক ঠান্ডু। ৫ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। ছোট থেকে চাষি পরিবারে বেড়ে উঠলেও বড় ভাইদের মত লেখাপড়া শেখার প্রতি তার ছিল অন্যরকম আগ্রহ। তিনি উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হন অর্থনীতি বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই তিনি ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের ছাত্রলীগ শাখার সহ-সভাপতির দায়ত্ব পালন করেছিলেন।
তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে যোগ দেন জাতিসংঘের অন্যতম একটি সংগঠন ইউনেস্কো'র একটি প্রকেক্টে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকান্ডকে মন থেকে মেনে নিতে না পারায় খুনিদের বিচারের দাবিতে হলেও রাজনীতিতে আসার ভাবনা সব সময় চিন্তা করতো জাহাঙ্গীর সিদ্দিক ঠান্ডুকে। বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে প্রত্যাবর্তন করলে তিনি পুনরায় সক্রিযভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। প্রথমদিকে ঢাকায় রাজনীতি করলেও পরবর্তীতে নিজ এলাকা কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারের নিরঞ্জন বাবু, আবদুল জব্বার ও মালেক মাস্টারের অনুপ্রেরনায় স্থানীয় ভাবে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৮০ সাল থেকে দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কালীগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়ত্ব¡ পালন করেছেন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে ঝিনাইদহ ৪ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে ভোট যুদ্ধে অবতীর্ণ হন তিনি। এ সময় তিনি জাতীয় পার্টির পার্টির প্রতিদ্বন্দি প্রার্ধী আবদুস সাত্তার মিয়ার নিকট মাত্র ১৫০ ভোটে পরাজিত হন। ১৯৯০ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টির প্রতিদ্বন্দি প্রার্থী মশিউর রহমানকে ৯ হাজার ভোটে পরাজিত করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে উপজেলা পরিষদ বিলুপ্তি ঘোষণার পর ১৯৯১ সালে আবারো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত ঝিনাইদহ ৪ আসনের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন। এ সময় প্রতিদ্বন্দি প্রার্থী জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) শহিদুজ্জামান বেল্টুর নিকট প্রায় ৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দি প্রার্ধী নুরুল ইসলামকে প্রায় ৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে পুনরায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে আবারো বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
সত্তোর্ধ কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ার আওয়ামী লীগের এই নেতা বৈবাহিক জীবনের নিঃসন্তান ছিলেন। ২০২৪ সালের ২১ জানুয়ারি তার স্ত্রী দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। জীবনের শেষ বেলায় এসে রাজনৈতিক কর্মকা- নিঃসঙ্গতাকে যেন গ্রাম করেছে। তার ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তা-চেতনা সবকিছুতে মিশে গেছে রাজনীতি। দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে উপজেলার বিভিন্ন রাস্তাঘাট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক উন্নয়ন অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ প্রয়োজনে এলাকার সাধারণ মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন মানুষের অকুন্ঠ ভালোবাসা। ঝিনাইদহ ৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার এর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নতুন করে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। সাংসদের আনুষ্ঠানিক মৃত্যুর ঘোষণা আসার সাথে সাথেই দৌড়ঝাপ শুরু করছে হবে কে হবেন পরবর্তী সংসদ সদস্য। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিক ঠান্ডুর সাথে রাজনীতির নানা দিক নিয়ে কথা বলেন। ঝিনাইদহ ৪ আসনের এমপি আনারের হত্যাকান্ডের ঘটনাকে পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ ধরনের হত্যাকান্ড রাজনীতিবিদদের জন্য অশনি সংকেত বলেও তিনি মনে করেন। এমপি আনার হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে কালীগঞ্জের মানুষের মনে শোকের আবহাওয়া বিরাজ করছে। আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং ছোট ভাই ছিল সংসদ সদস্য আনার। তার অপরিবর্তে তার পরিবার থেকে কেউ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী না হলে তিনি অবশ্যই ঝিনাইদহ ৪ আসনে সংসদ সদস্য পদের জন্য মনোনয়ন চাইবেন। সংকট কালীন এই সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গত দুই বারের ন্যায় তার উপর আস্থা রাখবেন বলে বিশ্বাস করেন। একই সাথে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, কালীগঞ্জে উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে একসাথে কাজ করার।