কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ছাতিরচরে ইউনিয়নে ঘোড়াউত্রা নদীতে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ পন্থায় বালু উত্তোলন করে চলছে একটি চক্র। এতে ভাঙনের কবলে পড়েছে নদীর আশপাশের এলাকা। গ্রামবাসীর দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন এই নদী। নদী ভাঙনের ফলে দীর্ঘ কয়েক যুগে এলাকার উত্তর দিকের বহু লোক বসত ভিটে হারিয়ে গ্রাম ছাড়া হয়েছেন।
উত্তর পূর্বাঞ্চলের ছাতক সুনামগঞ্জ হয়ে কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর সাথে সংযোগ ঘোড়াউত্রা নদীর। অপরদিকে বাজিতপুরের দিলালপুরে ঘোড়াউত্রার সাথে কালী নদী যুক্ত হয়ে মিশেছে মেঘনা নদীতে। ছাতিরচরের নদীর এই অংশটি আবহমান কাল থেকে বাৎসরিক লিজের আওতাধীন। পরবর্তীতে সরকারী জলমহাল নীতি, ২০০৯ অনুযায়ী বদ্ধ জলাশয়ের আওতাধীন দেখিয়ে বাৎসরিক লিজের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে নদীর এই অংশকে। এরপর থেকে সাধারণ জনগণ এখন আর স্বাধীনভাবে মৎস্য শিকারের সুযোগ পাননি অভিযোগ সাধারণ জেলেদের। এ ছাড়া আশপাশের আবদ্ধ জলাশয়গুলো এখন লিজে চলে যাওয়ার দিন মজুর জেলেদের পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন ভোগান্তি।
সম্প্রতি ১৪৩০ সালে দক্ষিণ গুরুই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির অধীনে ৫৩ লক্ষ ৫৯ হাজার ৯৯৮ টাকায় ঘোড়াউত্রা নদীর এই অংশটি ইজারা নেন ছেত্রা গ্রামের মাজহারুল হক। সরেজমিনে গেলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, নদীর বিভিন্ন অংশে প্রসাশনকে ফাঁকি দিয়ে প্রভাবশালীরা অবৈধ উপায়ে দীর্ঘদিন ধরে বালু উত্তোলন করে আসছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে এলাকার লোকজন প্রতিবাদ করার সাহস দেখায় না। এই কারণে বালু উত্তোলনে জড়িতদের দৌরাত্ম দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এ বিষয়ে ইজারাদার মাজহারুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি নদীটি বদ্ধ জলাশয় হিসাবে ইজারা নেইনি। এ ছাড়াও অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়ে আমার জানা নেই। আমি নিজে নদীতে যাই না। কর্মচারীরাও আমাকে বালু উত্তোলনের বিষয়ে কিছু জানায়নি।
গত ২৯ এপ্রিল ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ শনিবার বেলা প্রায় দুপুর ১২ টার সময়ে একটি ড্রেজার মেশিন পাইপ লাগানো অবস্থায় বালু উত্তোলনের খবর পেয়ে গুরুই ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা শাহজাহান হোসাইনী ঘটনাস্থলে গেলে মেশিন বন্ধ করে বালু উত্তোলনকারীরা একটি ট্রলারের মাধ্যমে পালিয়ে যান। এই সময়ে ঘটনাস্থল থেকে ড্রেজার মেশিনসহ পাইপ আটক করে স্থানীয় গ্রাম পুলিশ মতি মিয়া ও নুরুল ইসলামের জিম্মায় রাখা হয়। আর বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত মো. সিদ্দিক মিয়া (৬০), ফয়সাল মিয়া (৩২), নাদিম মিয়া (২৮), শিপন মিয়া (২৫) ও কাইয়ুম মিয়াকে (৩০) বালু মহাল ও মাটি ব্যাবস্থাপনা আইনের ২০১০ এর ৪ এর (গ) ও (ছ) ধারা মোতাবেকে ৩০ এপ্রিল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়।
গুরুই ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কমিশনার শাহজাহান হোসাইনী বলেন, আমি ৩০ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে থানায় গিয়ে ওসি মোহাম্মদ মুনসুর আলী আরিফের অনুপস্থিতে তদন্ত কর্মকর্তার নিকটে অবৈধ বালি উত্তোলনের কারণে পাঁচজনের নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি। নদীর জলমহাল ইজাদারের সম্পৃক্ততা আমি ঘটনাস্থলে পাইনি। যদি তদন্তে পুলিশ তার সম্পৃক্ততা পায়, তাহলে এই অভিযোগের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে মামলার বাদীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই আলমাস বলেন, আমি সাক্ষী দিতে হবিগঞ্জ আসছি। ঘটনার সত্যতা আছে। আমি বাদীকে অভিযোগ পরিবর্তন করে জমা দেয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু তিনি আর থানায় আসেননি তাই অভিযোগ এভাবেই পড়ে আছে।
ছাতিরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সামসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমার বয়স ৫৩ বছর আর নদী ভাঙনের কথা পিতা-মাতার মুখে শুনেছি আরো প্রায় ৭ বছর আগে থেকেই। গ্রামটি এখন তিন ভাগের ২ভাগই নদী ভাঙনে হারিয়ে গেছে। এখনো প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ২/৪টি পরিবার ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছে। বালি উত্তোলনের ফলে গ্রামটি আরো বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা সরকারিভাবে নিষেধ করা আছে। এ বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন বলেও জানান।
নিকলী থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, আমি নিকলী থানায় যোগদানের পরে অবৈধ বালি উত্তোলনের বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখব। প্রমাণিত হলে নেয়া হবে আইনি ব্যবস্থাও।