ষাটোর্ধ্ব আবদুল মোনাফ। পেশায় একজন দিনমজুর। গত ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। তবে, তাঁর পরিবারের দাবী মৃত্যুটি অস্বভাবিক। নিহত মোনাফ হাটহাজারী উপজেলার উত্তর ফতেয়াবাদ পশ্চিম খাগড়িয়া ছড়ারকুল এলাকায় বাসিন্দা। গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসিল্যান্ড) অফিসে নামজারী খতিয়ান বাতিল সংক্রান্ত মামলায় দুই কর্মচারীর অনৈতিক দাবি পূরণ না করায় তাঁর সঙ্গে লাঞ্চিত (গালাগাল ও অপমান) ঘটনা ঘটেছে অভিযোগ উঠেছে। এতে এসিল্যান্ড অফিসের কর্মচারীদের গালাগাল ও অপমানের ধকল সইতে না পেরে ওই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবী করেছে তাঁর ছোট মেয়ে আইরিন আক্তার।
গত রোববার তার পিতাকে লাঞ্চনাকারী এসি ল্যান্ড অফিসের দুই কর্মচারী যথাক্রমে বিজয় নন্দ বড়ুয়া এবং নিউটন বড়ুয়ার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে আবদুল মোনাফের বড় মেয়ে মিনু আক্তার। এদিকে, ওই অভিযোগ আমলে নিয়ে জেলা প্রশাসক এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠিত এবং এসি ল্যান্ড অফিসের ১৯ দালাল চিহ্নিত করেছে। অন্যদিকে, নিহত দিনমজুরকে দুই কর্মচারীসহ অন্যান্যের লাঞ্চিত করার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
যদিও সহকারী কমিশনার-ভূমি অফিস ও এ ঘটনায় অভিযুক্তরা বলছেন নিহতের পরিবারের অভিযোগ সত্য নয়। তারা জানান, গত ২০১৯ সালে নিহত মোনাফের প্রথম স্ত্রী নুর বেগমের কাছ প্রাপ্ত সম্পত্তি রেজিস্ট্রি দলিল মূলে পৌরসভার আলমপুর গ্রামের তিতাগাজী জামে মসজিদকে দান করে দেন। এর আগে ২০১৭ সালে ওই জমি পরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর অনুকূলে অধিগ্রহণ করা হয়। তাই জমি নিয়ে নামজারি পুনর্বিবেচনা মামলাটি নথিজাত করা হয়। এজন্য মোনাফকে জানানো হয়েছে তিনি যদি আপীল করতে চান তাহলে আদেশের সার্টিফাইড কপি নিয়ে রাজস্ব আদালতে আপীল করার পরমর্শ দেয়া হয়। গত আগস্ট মাসের শুরুতে ঘটনার দিন এ কথা বলার পর আবদুল মোনাফ অফিস সহকারী বিজয় নন্দ বড়ুয়াকে মা-বাবা ধরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং চিৎকার করে বলেন, আমি (মোনাফ) টাকা দেয়নি বলে আমার কাজ হয়নি। এ ছাড়া গালিগালাজ ও চিৎকার চেঁচামেচির একপর্যায়ে অফিস সহকারী নিউটন বড়য়াসহ অন্যান্য কর্মচারীগণ তাকে নিবৃত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তাকে আমারা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে আসলে তাকে জানাবেন বলে আশ্বস্ত করলে তিনি চলে যান। তবে, ঘটনার প্রায় ১ মাস ২০ দিন পরে হার্ট অ্যাটাক করে মোনাফ মারা গেছেন বলে যে অভিযোগ, যা বিশ্বাসযোগ্য নহে। তবে নিহতের ছোট মেয়ে আইরিন আক্তার দাবী করেন, নামজারী খতিয়ান বাতিল সংক্রান্ত মামলাটি নথিজাত করার আদেশের সার্টিফাইড কপি মাসের পর মাস এসি ল্যান্ড অফিসে ঘুরে ব্যর্থ হয়েছি।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, আইরিন আক্তারের প্রয়াত সৎ মা নুর বেগমের পৌরসভার মধ্য পাহাড়তলী মৌজায় পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সরকার অধিগ্রহন পরবর্তী অবশিষ্ট কিছু জমি এসিল্যান্ড অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর ও চিহ্নিত দালালদের যোগসাজশে জসিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি পৃথক নামজারি খতিয়ান (২৬৫৭ ও ২৮৯১) করে নেন। জমাভাগ মামলা নম্বর যথাক্রমে গ-২৩৯/১১ এবং গ-২১৪৯/১২। জমির পরিমাণ তিন শতাংশ। ওই খতিয়ান দুটি বাতিলের জন্য ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এসি ল্যান্ড বরাবর আবেদন করেন তার বাবা আবদুল মোনাফ ও বড় বোন মিনু আক্তার। তিন বছরের বেশি সময় ধরে এসিল্যান্ড অফিসে ঘুরলেও সেই খতিয়ান বাতিল না করে উল্টো তাদের আবেদনটি খারিজ করে দেন এসি ল্যান্ড অফিস। সাড়ে তিন বছরেও মামলা নিষ্পত্তি তো হয়নি, অনৈতিক দাবি পূরণ না করায় এবং জসিমের সাথে আঁতাত করে আবদুল মোনাফকে চরম হয়রানি করেন ভূমি অফিসের অফিস সহকারী বিজয় নন্দ বড়ুয়া।
আইরিনের অভিযোগ করে আরও বলেন, গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহের একদিন মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ জানতে গিয়ে বিজয় নন্দ বড়ুয়া এবং তার আরেক সহকর্মী নিউটন বড়ুয়ার হাতে আমার তার বাবা লাঞ্চিত এবং অপমানিত হন। এ সময় ভূমি অফিসে সেবাগ্রহীতার সাথে দুইজন সরকারি কর্মকর্তার এমন আচরণ দেখে সেদিন উপস্থিত সবাই বিস্মিত হন এবং বিরূপ মন্তব্য করেন। এসি ল্যান্ড অফিসের কর্মচারী বিজয় বড়ুয়া এবং নিউটন বড়ুয়া গালাগাল এবং অপমানের ধকল সইতে না পেরে আমার বৃদ্ধ পিতা মোহাম্মদ হঠাৎ হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ছিল। সেখান থেকে চিকিৎিসা নিয়ে ঘরে ফিরলেও এসিল্যান্ড অফিসের কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার তিনি ভুলতে পারছিলেন না। গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে ফের তাঁর শারীরিক অবস্থার হঠাৎ অবনতি হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা তার পিতাকে কে মৃত ঘোষণা করেন। আমরা চার বোন ও এক ভাই, এদের মধ্যে ভাইটি মানসিক ভারসাম্যহীন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবার মৃত্যুতে আমাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত বিজয় বড়ুয়া বলেন, ‘আমি ওনার সাথে খারাপ আচরণ করিনি। ওনি উল্টো আমার সাথে খারাপ আচরণ করেছেন। আমাকে গালি দিলে আমিও রাগের মাথায় তাকে বেয়াদপ বলেছি। আর তাকে অফিস থেকে বের করে দিতে বলছি।
ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলে হাটহাজারীর সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসিল্যান্ড) মো. আবু রায়হান বলেন, আমি এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। কেউ আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দেননি। যে দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে তারা আমার দপ্তরের স্টাফ। ইতোমধ্যে তাদের বদলি আদেশ হয়েছে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, ওই ঘটনায় এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া হাটহাজারীর সহকারী কমিশনার-ভূমি (এসিল্যান্ড) ১৯ দালাল চিহ্নিত করা হয়েছে। অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।