
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু এবং ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সর্বগ্রাসী এ যুদ্ধে শুধু মানবসন্তানই নিহত হয়েছে পাঁচ কোটি, আহত হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি।
যুদ্ধের কারণ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ হচ্ছে, তথাকথিত অক্ষশক্তিÑজার্মানি, ইতালি ও জাপানের একনায়কদের অন্যদেশ দখলের উচ্চাভিলাষ। এ ছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তিসৃষ্ট সীমান্ত বিরোধ এবং তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটও এ যুদ্ধে শুরুর ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
ঝটিকা অভিযান : জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু। ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণা করলেও জার্মানির অগ্রাভিযানে তা তেমন প্রভাব ফেলেনি। নিজের সীমান্তকে সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে রাশিয়া পোল্যান্ড আক্রমণ করে। ১৯৪০ সালের এপ্রিলে জার্মানি ডেনমার্ক ও নরওয়ে দখল করে নেয়। মে মাসে জার্মানি শুরু করে তার বিশেষ রণ কৌশল ঝটিকা অভিযান। মাত্র সাত সপ্তাহের এই ঝটিকা অভিযানে জার্মানি মিত্রশক্তিকে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলে এবং দখল করে নেয় বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্স। ব্রিটিশবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করার মধ্য দিয়ে জার্মানি প্রায় পুরো ইউরোপের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে ব্রিটেন বেছে নেয় ঝটিকা বিমান আক্রমণের কৌশল, শুরু করে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ। ভাল ফল পাওয়া যায় এতে। হিটলারের আগ্রাসন পরিকল্পনা থমকে দাঁড়ায়। এ সময় ইতালি যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে।
পূর্বফ্রন্ট : ১৯৪১ সালের গ্রীষ্মে জার্মানি আক্রমণ করে বসে যুগোস্লাভিয়া, গ্রিস ও রাশিয়া এবং ঝড়ের বেগে পৌঁছে যায় মস্কোর উপকণ্ঠে। রাশিয়া প্রচ- প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি আগত শীতের কথা মাথায় রেখে ধীরে ধীরে পশ্চাদপসরণের কৌশল অবলম্বন করে, জার্মান সেনাবাহিনীকে টেনে নিয়ে যায় দেশের দুর্গম এবং গভীরতম অঞ্চলে। ১৯৪২ সালের গ্রীষ্মে জার্মানবাহিনী আরও অগ্রসর হয়ে স্তালিনগ্রাদে (বর্তমানে ভলগোগ্রাদ) সোভিয়েত বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ধীরে ধীরে এসে পড়ে কিংবদন্তিতুল্য রাশিয়ার শীতকাল। ১৯৪৩ সালের প্রথম দিকে সোভিয়েত বাহিনী ধ্বংস করে দেয় জার্মানির স্তালিনগ্রাদ অবরোধ। এর এক বছর পর অবরোধমুক্ত হয়। লেনিনগ্রাদ। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটতে বাধ্য হয় জার্মানবাহিনী।
উত্তর আফ্রিকা : লিবিয়ায় অবস্থানরত ইতালীয় বাহিনী মিসর আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৯৪২ সালে মিসরের এল-আল আমিন নামক স্থানে ব্রিটিশ সৈন্যরা ইতালীয় বাহিনীকে শুধু প্রতিরোধই করেনি, পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে। মরুযুদ্ধে ব্রিটিশবাহিনী নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে শেষপর্যন্ত অর্জন করে বিজয়।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধ : ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবারে জাপানের বোমাবর্ষণের মধ্য দিয়ে কোনরকম আগাম সতর্কতা ছাড়াই শুরু হয় এ যুদ্ধ। মাত্র সাত মাসের মধ্যে জাপান দখল করে নেয় বর্মা, হংকং মালয়েশিয়া, ডাচ পূর্বইন্ডিজ, থাইল্যান্ড ও ফিলিপিন্স। আক্রমণ করে নিউগিনি এবং হুমকি সৃষ্টি করে অস্ট্রেলিয়ার প্রতি। জাপানের এই আগ্রাসন অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য করে।
মিত্রশক্তির পাল্টা আক্রমণ : ১৯৪২ সালের নবেম্বরে ব্রিটিশ ও মার্কিনবাহিনী অক্ষশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন ফরাসি উত্তর আফ্রিকা আক্রমণ করে এবং ১৯৪৩ সালের মে মাসের মধ্যে তা পুরোপুরি দখল করে নেয়। আফ্রিকা থেকে মিত্রবাহিনী সিসিলি ও ইতালির মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ চালায়। ইতালির মানুষ সে দেশের ফ্যাসিস্ট একনায়ক মুসোলিনিকে প্রত্যাখ্যান করে মিত্রশক্তির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। জার্মানবাহিনী মধ্য ও উত্তর ইতালিতে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৯৪৪ সালের জুনে ব্রিটেন থেকে বিপুল সংখ্যক মিত্রবাহিনী সৈন্য উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে অবতরণ করে। মিত্রবাহিনী আগস্টে প্যারিস মুক্ত করে এবং ১৯৪৫ সালের গোড়ার দিকে জার্মান সৈন্যদেরকে রাইন নদীর অপর পারে বিতাড়িত করে অপরাদিকে রুশবাহিনী নতুন এক অভিযান শুরু করে এবং ১৯৪৪ সালের শেষ নাগাদ জার্মানিকে সমর্থনকারী চারটি দেশ বুলগেরিয়া, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও রোমানিয়া দখল করে নেয়।
১৯৪৫ সালের এপ্রিলে রুশ ও মার্কিনবাহিনী মিলিত হয় জার্মানির হৃৎপি- বলে পরিচিত এলবি নদীর তীরে। পরাজিত জার্মান নেতা হিটলার ৩০ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন বার্লিনের একটি বাঙ্কারে। এর সাতদিন পর বিধ্বস্ত জার্মানবাহিনী চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণ করে মিত্রশক্তির কাছে।
জাপানের পরাজয় : ১৯৪২ সালের জুনে প্রশান্ত মহাসাগরের প্রবাল সাগর ও মিডওয়েতে মার্কিন নৌবহরের হাতে জাপানি নৌবাহিনীর পরাজয়ের মধ্যদিয়ে থেমে যায় জাপানের বিজয়রথ। এর কয়েক মাসের মাথায় মার্কিনবাহিনী জাপানের নিয়ন্ত্রণাধীন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো ধীরে ধীরে পুনর্দখল করতে শুরু করে। পরপর কয়েকটি প্রচ- যুদ্ধে মার্কিনবাহিনী দখল করে নেয় গিলবার্ট, মার্শাল, ক্যারোলিন এবং মারিয়ানা দ্বীপ। মারিয়ানা থেকে মার্কিন বোমারু বিমান জাপানে বোমাবর্ষণ শুরু করে। ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিনবাহিনীর ফিলিপিন্স আক্রমণের সূচনা। অপরদিকে ব্রিটিশবাহিনী চালায় বর্মা পুনর্দখলের অভিযান। পাশাপাশি মার্কিনবাহিনী দ্রুত পৌঁছে যায় চীন সীমান্তে, যেখানে চীনা সৈন্যরা জাপানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে ১৯৩৭ সাল থেকে।
১৯৪৫ সালের শেষ নাগাদ মিত্রশক্তি খোদ জাপান আক্রমণের কৌশল গ্রহণ করে। মিত্রবাহিনীর হাতে কোণঠাসা জাপানের আত্মসমর্পণ যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখনি নেমে আসে বিপর্যয়। নব-আবিস্কৃত ভয়াবহ মারণাস্ত্রটি পরীক্ষা করে দেখার মূল উদ্দেশ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালের ৬ অগাস্ট প্রথম পরামাণু বোমা নিক্ষেপ করে জাপানের হিরোশিমা নগরীতে। বর্ধিষ্ণু একটি শহর মুহূর্তে পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে, নিহত হয় কয়েক লাখ মানুষ। হিরোশিমা ট্র্যাজেডির তিন দিন পর আরেকটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয় জাপানের নাগাসাকি শহরে। পরিণতি একই রূপ ভয়াবহতা। ১৪ আগস্ট জাপান আত্মসমর্পণ করে মিত্রশক্তির কাছে।
ফল : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি ও জাপানের দখলকৃত দেশগুলো তাদের হৃতমর্যাদা ফিরে পায়। কিন্তু ইউরোপে সোভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট সরকার। এ ছাড়া পূর্ব জার্মানিতেও কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বার্লিন নগরী বিভক্ত হয় দুভাগে, তৈরি হয় ঐতিহাসিক বার্লিন প্রাচীর।