
১৯১৪ সালের জুনে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রানৎস ফার্দিনান্দ গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার পরপরই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৮ সালের ১১ নবেম্বর এক অস্ত্রবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে শেষ হয় সাড়ে ৪ বছর স্থায়ী ভয়াবহ এ যুদ্ধ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ
প্রলয়ঙ্করী এই যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ব্যবসাবাণিজ্য, উপনিবেশ এবং নৌ ও সামরিক শক্তি নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর পারস্পরিক উন্মত্ত প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত ইউরোপীয় দেশগুলো গড়ে তোলে একাধিক প্রতিরক্ষা জোট। ফলে একটি দেশ আক্রান্ত হলে জোটের অন্যান্য দেশও জড়িয়ে পড়ে সর্বনাশা যুদ্ধে। ইউরোপের প্রধান দুটি জোটের একটি ছিল ব্রিটেন, রাশিয়া ও ফ্রান্সের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় আঁতাত এবং অপরটি ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ও হাঙ্গেরির সমন্বয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় জোট। প্রথমদিকে ইতালি এ জোটের সদস্য হলেও পরবর্তীকালে ১৯১৪ সালের আগস্টে সে নিজেকে নিরপেক্ষ ঘোষণা করে।
যুবরাজ ফার্দিনান্দের হত্যাকাণ্ডের পর অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি-এর জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে সে দেশ আক্রমণ করে। সার্বিয়ার সমর্থনে এগিয়ে আসে রাশিয়া। অপরদিকে জার্মানি যুদ্ধ ঘোষণা করে রাশিয়া ও তার মিত্র ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। ফ্রান্স আক্রমণের ভিত্তি তৈরির লক্ষ্যে জার্মানি বেলজিয়ামে আগ্রাসন চালায়। পরবর্তীকালে তুরস্ক ও বুলগেরিয়া জার্মানির সঙ্গে যোগ দেয়। অপরদিকে জাপান, ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্র ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের তথা ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার সমর্থনে এগিয়ে আসে।
পশ্চিম ফ্রন্টে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে শুরু হয় মরণপণ যুদ্ধ। প্রথমদিকে জার্মানি কিছুটা সাফল্য অর্জন করে। পরে উভয় পক্ষই বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পরিখা খনন করে, যা প্রতিরক্ষার জন্য তুলনামূলকভাবে সহজ এবং আক্রমণের জন্য বেশ কঠিন। তখন থেকে পরবর্তী সময়ে পশ্চিম ফ্রন্টে সংঘটিত হয় একাধিক ব্যয়বহুল সর্বনাশা লড়াই। মাত্র কয়েক মাইল জায়গা দখলের জন্য প্রাণ দিতে হয় লাখ লাখ মানুষকে। এমনকি বিষাক্ত গ্যাস ও ট্যাংকের মতো নতুন অস্ত্রের আবিষ্কারও এই অচলাবস্থা ভাঙতে ব্যর্থ হয়। ১৯১৮ সালের মার্চে জার্মানি প্যারিসে পৌঁছার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। কিন্তু এর ফল হয় বিপরীত। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে জার্মানি বেশ কাহিল হয়ে পড়ে। ফলে মিত্রশক্তির পাল্টা আক্রমণে শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে জার্মান প্রতিরক্ষা ব্যুহ।
পূর্ব ফ্রন্ট বিস্তৃত ছিল ১১শ’ মাইলÑবাল্টিক সাগর থেকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত। রাশিয়া শুরুতে প্রুশিয়া সীমান্তে এবং বলকানের দিকে কিছুটা অগ্রসর হয় এবং প্রচ- যুদ্ধের পর পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক, যা তাকে শত্রুপক্ষের চেয়ে বেশি দুর্বল করে ফেলে। এমনি অবস্থায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় রাশিয়ার বলশেভিক সরকার বরং খুশিই হয়। উল্লেখ্য, ১৯১৭ সালের অক্টোবরে এক সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে। কমিউনিস্ট পার্টির বলশেভিক অংশ এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয় এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
দক্ষিণ ফ্রন্টের বিস্তৃতি ইতালি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির মধ্যবর্তী ইসোনজো নদীর তীর জুড়ে। কিন্তু ১৯১৭ সালে ইতালি পিয়েভ নদী পর্যন্ত পিছু হঠতে বাধ্য হয়।
মধ্যপ্রাচ্য : ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ, অস্ট্রেলীয় ও নিউজিল্যান্ডের সেনাবাহিনী তুরস্কের নিয়ন্ত্রণাধীন দারদানেলিস প্রণালী দখলের চেষ্টা করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলোর মাধ্যমে রাশিয়ায় সৈন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও উচ্চ পর্যায়ের কমান্ডারদের মধ্যে মতবিরোধ ও সমন্বয়হীনতার কারণে এ অভিযান ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশবাহিনী মেসোপোটেমিয়া ও ফিলিস্তিনের যুদ্ধের তুরস্ককে পরাজিত করে এসব অঞ্চল দখল করে নেয়।
সাগরে যুদ্ধ : জার্মানি ও ব্রিটেন, উভয়েরই ছিল বিশাল নৌবহর। তা সত্ত্বেও প্রবল দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে সাগরে বড় ধরনের যুদ্ধ হয়েছে বলতে গেলে একটাই। আর তা হয়েছিল ১৯১৬ সালে জুটল্যান্ড বন্দরের অদূরে। এ যুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে জেতেনি কোন পক্ষই। তবে যুদ্ধের পরেও জার্মান নৌবহর বন্দরে থেকে যায়। জার্মান নৌবাহিনী মূলত নির্ভরশীল ছিল তার বিশাল সাবমেরিন বহরের ওপর। জার্মান নৌবাহিনী সাবমেরিনের সাহায্যে আঘাত হানতে শুরু করে খাদ্য ও যুদ্ধের উপকরণবাহী ব্রিটিশ সওদাগরি জাহাজের ওপর। এতে ১৯১৭ সাল নাগাদ চরম খাদ্য ঘাটতির মুখে পড়ে ব্রিটেন।
আকাশ যুদ্ধ : উড়োজাহাজ অস্ত্র হিসাবে প্রথম ব্যবহৃত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। প্রথম দিকে বিমান ব্যবহৃত হত পর্যবেক্ষণ ও স্থল আক্রমণে সহায়তার কাজে। কিন্তু পরবর্তীকালে যুদ্ধক্ষেত্রের পেছনের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে ব্যাপক বোমাবর্ষণের কাজে শুরু হয় বিমানের ব্যবহার। জার্মানি বোমা বর্ষণের কাজে ব্যবহার করে তার জেপেলিন বোমারু বিমান। কিন্তু এ বিমানের প্রধান দুর্বলতা ছিল, এগুলো অপেক্ষাকৃত সহজেই গুলি করে ভূপাতিত করা যেত।
শান্তি চুক্তি : জার্মানি ও তার মিত্রদের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে পাঁচটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা যৌথভাবে প্যারিস শান্তিচুক্তি হিসাবে পরিচিত। ভার্সাই চুক্তি নামে পরিচিত মূল শান্তি চুক্তিতে চরম মূল্য দিতে হয় জার্মানিকে। জার্মানির জন্য এটি ছিল অত্যন্ত অবমাননাকর এবং এ চুক্তি তার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দেয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জার্মানি তার মূল ভূখণ্ডের প্রায় এক সপ্তমাংশ এবং উপনিবেশগুলোর পুরোটাই হারায়। এ ছাড়াও তাকে বাধ্য করা হয় ক্ষতিপূরণ হিসাবে বিপুল অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিতে। কিন্তু যুদ্ধ জার্মানিকে এতটাই হতবল করে ফেলেছিল যে, প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের পুরো অর্থ সে দিতেই পারেনি।