এলাকার মানুষ ভালোবেসে আমাকে চেয়ারম্যান পদে ভোটে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রথমে আনন্দ অনুভব করলেও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। তফসিল ঘোষণার কয়েকদিনের মধ্যে চারদিকে যেন ভীতিকর এক পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়। ভয় পেলেও বুঝতে পারছিলাম, জনগণ আমাকে ভালোবাসে, আমার সঙ্গে আছে। তাদের ভালোবাসা আমাকে সাহস যুগাচ্ছিল। আমি ভোটের মাঠে শত বাধার পরও লড়ে যাচ্ছিলাম। তবে সব শেষে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার খবর সব কষ্ট মিলিয়ে যায় বিজয়ের উলস্নাসে। ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গের কোনো ব্যক্তি হিসেবে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া নজরুল ইসলাম ঋতু এভাবে বর্ণনা করছিলেন। অনেক বাধার অঅসছিল নির্বাচনের সময় কিন্তু ভয় পায়নাই এলাকার ভালবাসার মানুষের কারনে।
গত ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুরে ৯ হাজার ৫৫৭ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী নজরুল ইসলাম ঋতু। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দি নৌকা প্রতিকের আওয়ামী লীগ প্রার্থী নজরুল ইসলাম সানা পেয়েছেন ৪৫২৯ ভোট।
নজরুল ইসলাম ঋতু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল পরিবেশ ততই ভীতিকর হয়ে উঠছিল। প্রতিপক্ষের প্রতিদ্বন্দি ও তার সমর্থকরা আমার কোনো পোস্টার প্রদর্শনের সুযোগ দিচ্ছিল না। সব পোস্টার ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছিল। আমার কর্মী-সমর্থকদের মারপিট করা হচ্ছিল। আমাকে ভোটের মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছিল না। কিন্তু আমি আমার কর্মীদের অভয় দিয়ে বলেছিলাম, 'আমার পোস্টার যতই ছিঁড়ুক না কেন, আমার কোনো অসুবিধা নেই। মানুষের মনের ভেতর যে পোস্টার ঢুকে গেছে, সেটা তারা ছিঁড়ে নিতে পারবে না। শত বাধার ভিতর দিয়ে দমন হয়নি সে। তার বাড়িতে হামলার চেষ্টা করেছি রাতে, কিন্তু কালীগঞ্জ থানা পুলিশের হস্তক্ষেপে তারা ব্যার্থ হয়।
নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি তার নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি মহল্লায় বাড়ি বাড়ি ও হাট-বাজারে গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন। এ সময় তিনি তার ভোটাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমার খুব ভালো লাগছে। কারণ, আপনারা আমাকে পাঁচ হাজারের বেশি ভোটে নির্বাচিত করেছেন। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। আপনাদের এ ভঅলবাসা আমি পরিশোধ করতে পারবো না। ভোটাররা কেন আপনাকে ভোট দিয়েছে- এমন প্রশ্নে ঋতু বলেন, গত ১৫ বছর ধরে আমি জনগণের মাঝে আছি। তাদের আমি ভালোবেসেছি, তারাও আমাকে ভালোবাসে, সে কারণেই ভোট দিয়েছে। মানুষের বিপদ ও সমস্যার কথা জানা মাত্রই ছুটে যেতাম। দেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা প্রশ্নে ঋতু জানান, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা সমাজে অবহেলিত। প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান অধিকার দেওয়া হয় না। মাত্র কয়েক বছর হলো ভোটার তালিকাতাদের নাম অন্তগত করা হয়েছে। সুযোগ পেলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের দক্ষ জনবল হিসেবে তৈরি করার ব্যবস্থা করব। সমাজে আমরা অবহেলার পাত্র, সবাই ঘৃণার চোখে দেখে। কিন্তু আজকে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, মানুষ তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে- এটা অনেক বড় পাওয়া। এখন আমার লক্ষ্য, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। জনগণের জন্য যা করা দরকার বলে মনে হবে, তিনি সেগুলোই করবেন বলে জানান। তিনি আশা করছেন, তার দায়িত্ব পালনে সবার সহযোগিতা পাবেন।
উপজেলা নির্বাচন অফিসার আলমগীর হোসেন জানান, আমাদের সমাজের মূল ¯্রােতধারার বাইরে থাকা এই মানুষটি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। আমি তাকে স্বাগত জানাই। এখন নিশ্চয়ই সে ভালো সেবা করে প্রমান করতে পারবে, তারাও আমাদের সমাজের অন্য দশজনের মতোই।
বিজয়ী চেয়ারম্যান ঋতু উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের মৃত আবদুল কাদেরের ছেলে। জন্মের পর তৃতীয় লিঙ্গ প্রকাশ পাওয়ায় ৭ বছর বয়সে তাকে গ্রাম ছেড়ে ঢাকা চলে যেতে হয়। ঢাকার ডেমরা থানায় দলের গুরুমার কাছেই তার বেড়ে উঠা। এখন তার বয়স ৪৩ বছর। গুরুমার পরের দায়িত্বটা তিনি দেখভাল করেন। ঢাকায় থাকলেও পরিবারের টানে প্রায়ই বাড়িতে আসতেন। কষ্টার্জিত জমানো অর্থ দিয়ে বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে জন্মস্থান দাদপুর গ্রামসহ ইউনিয়নবাসীর উন্নয়নে সহযোগিতা করে আসছেন তিনি।