সূর্যাস্তের আগেই সিগন্যালের বাতি জ¦ালিয়ে দিচ্ছেন মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশনের পি-ম্যান সানু প্রামানিক পার্শ্ববর্তী স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে আসার সংবাদ পাওয়া গেছে। তোড়জোড় দেখা গেল স্টেশনে কর্মরত পয়েন্টম্যানদের (পি-ম্যান) মধ্যে। স্টেশন মাস্টার নির্দেশনা দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা চাবিটি পি-ম্যানের হাতে তুলে দিয়ে থাকেন প্রতিনিয়ত। চাবি নিয়ে পি-ম্যান স্টেশনের অদূরে পয়েন্ট এলাকার দিকে রওনা হন তড়িঘড়ি করে। যেখান থেকে ঠিক করা হয় ট্রেনটি স্টেশনের সামনে থাকা কোনো লাইনে প্রবেশ করবে। ট্রন প্রবেশের আগে পয়েন্ট নিশ্চিত করতে বেশ মনোযোগী পি-ম্যান। চাবি দিয়ে পয়েন্টের তালা খোলার পর রেললাইনের পাশে স্থাপিত টার্মলার উঁচু করে একপাশ থেকে আরেক পাশে নিয়ে পয়েন্ট নিশ্চিত করলেন। লোহার তৈরি টার্মলারটির ওজন ২৬ কেজি। এরপর আরও একটি চাবি দিয়ে তালা লক করলেন, যেন পয়েন্ট সরে না যায়। পয়েন্ট সরে গেলেই ঘটবে দূর্ঘটনা। সব ঠিকঠাক আছে কিনা শেষবারের মতো পর্যবেক্ষণ করে পি-ম্যান ফিরে আসেন স্টেশনে। চাবিটি বুঝিয়ে দেন কর্তব্যরত স্ট্রেশন মাস্টারের হাতে। পয়েন্ট নিশ্চিতের চাবি হাতে পেয়ে ট্রেন স্টেশনে প্রবেশের সিগন্যালের নির্দেশ দেন স্ট্রেশন মাস্টার। নির্দেশ পেয়ে সিগন্যাল ম্যান স্টেশনের কেবিন থেকে হ্যান্ডেল চেপে স্টিলের তার টেনে ট্রেন প্রবেশের সিগন্যাল তৈরি করেন। অপেক্ষা করতে হয় ট্রেন আসার এবং স্ট্রেশনে দাঁড়িয়ে থাকে শত শত যাত্রি।।
এভাবেই প্রতিদিনই আপ-ডাউনে মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশনের উপর দিয়ে যাতায়াত করে যাত্রীবাহী ও মালবাহী মিলে ২০ থেকে ২২টি ট্রেন।
ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত পয়েন্ট ব্যবস্থায় চলছে এ অঞ্চলের সব থেকে বড় রেল স্টেশন খুলনা ও যশোর। বাকি স্টেশন গুলোয় ব্রিটিশ ব্যবস্থার আংশিক পরিবর্তন করা হলেও আধুনিক করা হয়নি। সেখানেও একটি কেবিন থেকে হ্যান্ডেল চেপে স্টিল বা অ্যালুমিনিয়াম তার টেনে ট্রেন প্রবেশের পয়েন্ট ও সিগন্যাল তৈরি করা হয়। এ কারণে নানা অঘটনের মুখে পড়তে হয় এ অঞ্চলে চলাচলকারী ট্রেন ও যাত্রীদের।
একই রকম নাজুক অবস্থা এ অঞ্চলের সিগন্যাল ব্যবস্থায়ও। রাতের ট্রেন চলাচলে ভরসা কেরোসিন বাতির সিগন্যাল। সামান্য ঝড় বাতাস হলেই নিভে যায় বাতি। তখন আবার জ¦ালিয়ে দিতে হয়। সিগন্যাল বাতি না পেয়ে অনেক সময় মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রেন। ঘন্টার পরঘন্টা ফাকা মাঠের দাঁড়িয়ে থাকার কারণে যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তার অভাব হয়ে পড়ে। মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশনের পয়েন্ট ম্যান মোহাম্মদ মকবুল হোসেন জানান, প্রতিদিনই সন্ধ্যার আগে বাতি জ¦ালিয়ে দিয়ে আসি। অনেক সময় সামান্য বাতাস কিংবা ত্রুটির কারণে আলো নিভে যায়। তখন সিগন্যাল দেখতে না পাওয়ায় স্টেশন ইয়ার্ডের বাইরে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রেন। তখন আবার বাতি জ¦ালিয়ে দিলে ট্রেন স্টেশনে প্রবেশ করে।
কোটচাঁদপুর স্টেশনের পয়েন্ট অপারেটর সঞ্জয় বিশ্বাস জানান, ব্রিটিশ আমলের এসব সিগন্যাল অপারেট করতে পড়তে হয় মারাতœক সমস্যায়। অনেক সময় তারে ত্রুটি থাকলে সিগন্যাল ওঠে না। তাই সঠিক ভাবে সিগন্যাল পরিচালনা করতে ও ট্রেন দুর্ঘটনা এড়াতে কালার বাতি ও আধুনিক কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এভাবে জগাখিচুড়ি করে চালানো কষ্টকর ব্যাপার।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন রেল চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ সিগন্যাল এবং পয়েন্টিং ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় সামান্য ত্রুটি হলেই ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। দেশের সব বিভাগে আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগলেও দক্ষিণাঞ্চলের রেল বিভাগ একেবারেই ভিন্ন। এ এলাকার রেল চলছে ব্রিটিশ আমলের তৈরি ম্যানুয়াল পদ্ধতির সিগন্যাল আর পয়েন্টিংয়ের ওপর ভর করে ট্রেন চলাচল করে থাকে। এভাবে চলাচল অত্যান্ত ঝুকিপূর্ন। এ অঞ্চলের ডাবল রেলওয়ে নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন হয়ে আছে। কাজ শুরু হলে পয়েন্ট ও সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করা হবে। তখন পয়েন্ট এলাকায় না গিয়ে ঘরে বসেই পয়েন্ট বা সিগন্যাল করা যাবে। গতি আসবে এ অঞ্চলে ট্রেন চলাচলে, বাড়বে যাত্রীসেবা। তবে কবে নাগাদ এ কাজ শুরু হবে তা বলতে পারেননি কর্মকর্তারা।
একজন কর্মকর্তা বলেন, এ অঞ্চলের অনুমোদিত ডাবল লাইনের কাজ আপাতত স্থগিত করা রয়েছে। কবে সে কাজ শুরু হবে তা বলতে পারেনি সূত্রটি। ইতোমধ্যে একই ওয়েতে রাজশাহী থেকে দর্শনা পর্যন্ত আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। কিন্তু বাকি রয়েছে দেশের একমাত্র রেলপথ দর্শনা থেকে খুলনা পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার।
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের পাকশী বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দর্শনা থেকে খুলনা পর্যন্ত ২০টি রেলস্টেশন রয়েছে। তন্মধ্যে ৭টি স্টেশনে পয়েন্ট ও সিগন্যাল ব্যবস্থায় ব্রিটিশ সরকারের আমলে তৈরি করাহয়। নন-ইন্টারলকিং পদ্ধতি চালু রয়েছে এখন। চারটি রেলস্টেশন খুলনা, খুলনা জংশন, বেনাপোল ও নাভারনে ব্রিটিশ আমলের পয়েন্টিং ব্যবস্থা বহাল রেখে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সিগন্যাল ব্যবস্থায় কালার লাইট স্থাপন করা হয়। বাকি ১৩ স্টেশন ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালে ব্রিটিশ পয়েন্ট ও সিগন্যাল ব্যবস্থার পরিবর্তন করে ডাবল ওয়্যার মেকানিক্যাল ইন্টারলকিং পদ্ধতি স্থাপন করা হয়। এ ব্যবস্থায় স্টেশনের নির্দিষ্ট কেবিন থেকে হ্যান্ডেল চেপে এ্যালুমিনিয়াম তার টেনে ট্রেন প্রবেশের পয়েন্ট ও সিগন্যাল তৈরি করা হয়। অনেক সময় পয়েন্ট সিগন্যাল না হলে স্টেশনের অদূরে মাঠের মধ্যে ট্রেন দাঁড় করিয়ে রাখা হয় দীর্ঘ সময়। এসব স্টেশনের প্রতিটির উভয় পাশে ১০ থেকে ১২টি সিগন্যাল রয়েছে। যার অধিকাংশই কেরোসিন বাতিতে জ¦লে। অল্প কিছু আছে যেগুলো ব্যাটারি বা সোলার সিস্টেমে জ¦ালানো হয়। এক লিটার কেরোসিনে ৩ থেকে ৪ দিন চলে থাকে। অনেক সময় প্রতিদিন কেরোসিন কিনতে হয়।
যশোর রেলওয়ে স্টেশনে কর্মরত সহকারী কেবিন মাস্টার (এসিএম) আনিচুর রহমান ও পি-ম্যান আশরাফুজ্জামান লিটন জানান, প্রতিদিন স্টেশনের এক পাশে ৯ থেকে ১০টি ট্রেনের পয়েন্ট করতে হয়। এজন্য ঝড়, রোদ- বৃষ্টিসহ যে কোনো প্রতিকুল আবহাওয়া উপেক্ষা করে প্রতিবারই সংশ্লিষ্ট স্থানে গিয়ে পয়েন্ট করতে হয়। পয়েন্ট তৈরির জন্য স্পিং লেবার, টার্মলার এবং আর্ট লেবার ব্যবহার করতে শক্তিরও প্রয়োজন। পয়েন্ট তৈরি যে কেউ করতে পারে না।
পয়েন্ট ব্যবস্থায় কখনো কখনো সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। তখন পি-ম্যান মাস্টার সাহেবকে অবগত করানো হয়। মাস্টার সিগন্যাল বিভাগের খবর দিলে তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে সমস্যা সমাধান করে থাকে। অনেক সময় কাজ করতে দেরি হলে বিকল্প লাইনে ট্রেনটি প্রবেশ করানো হয়। বিকল্প লাইনেও ট্রেন থাকলে বা অন্য কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে ট্রেন মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এতে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা।
২০২০ সালে কপোতাক্ষ ও সুন্দরবন এক্সপ্রেস এবং তেলবাহীসহ চারটি ট্রেন লাইনচ্যুত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে পড়ে। ২৬ অক্টোবর দিবাগত রাত ১.৪২ মিনিটে সাফদারপুর রেল স্টেশনে পাথর ও তেলবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সংঘর্ষে তেলবাহী ট্রেনের পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়। তিনটি ট্যাংক ফেটে প্রায় ২ লাখ লিটার তেল মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। খুলনার সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ থাকে ১০ ঘণ্টা। সবশেষ চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি কোটচাঁদপুর রেলস্টেশনে সুন্দরবন এক্স্রপ্রেসের দুটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। এতে খুলনার সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দূর্ঘটনার পর উভয় পাশে যাতায়াতকারী ট্রেন গুলো বিভিন্ন স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ফলে বিপাকে পড়েন দুরপাল্লার যাত্রীরা। প্রতিটি দুর্ঘটনা ঘটেছে সন্ধ্যার পর থেকে রাতের বিভিন্ন সময়। এমন পরিস্থিতিতে ট্রেন দুর্ঘটনা এড়াতে সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ জরুরি বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা।
এ অঞ্চলের ট্রেনের চালকরা বলছেন, দ্রুত গতিতে ট্রেন চালানো যায় না। নির্দিষ্ট গতি মেনে ট্রেন চালানো হয়। কিন্তু সিগন্যাল ব্যবস্থা সব থেকে বেশি খারাপের কারণে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। রাতে দূর থেকে কিছু দেখা যায় না। প্রায়ই সিগন্যাল না পেয়ে রেলস্টেশনে প্রবেশের আগেই মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আর রাতের বেলা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়লে যাত্রীরা আতংগ্রস্থ হয়ে পড়ে। মালবাহী ট্রেনের চালক আমিরুল ইসলাম জানান, সীমা-৪ আর্ম সিগন্যাল, যেগুলো কালার না সেখানে ট্রেন থামাতে হলে ৪৪০ গজ জায়গা লাগে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিগন্যাল ঠিকমতো জ¦লে না বা দেখা যায় না তখন দূরত্ব না পাওয়ায় ট্রেন সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশন মাস্টার শাজাহান শেখ জানান, বর্তমান সিগন্যাল ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ নয়। আধুনিক হলে বিদ্যমান সমস্যা গুলো সমাধান হবে। তখন এ অঞ্চলের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীসেবাও নিশ্চিত করা যাবে।
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের পাকশী বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী এমএম রাজিব বিল্লাহ ব্রিটিশ ও বাংলাদেশ রেলওয়ের পয়েন্ট ও সিগন্যাল ব্যবস্থার সমস্যা এবং সুবিধা উল্লেখ করে জানান, রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী থেকে দর্শনা পর্যন্ত ডাবল লাইনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ফলে ওই এলাকার সিগন্যাল ও পয়েন্টিং ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন হয়েছে। বাকি দর্শনা থেকে খুলনা পর্যন্ত ডাবল লাইনের কাজের প্রকল্প অনুমোদন হয়ে রয়েছে। অর্থ পাওয়া সাপেক্ষে কাজ শুরু করা হবে। তবে কি নাগাদ শুরু হবে তা বলা যাচ্ছেনা।
পুরনো ম্যানুয়াল পদ্ধতির পয়েন্ট ও সিগন্যাল ব্যবস্থার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে এমন প্রশ্নে তিনি জানান, এককভাবে কাউকে দায়ী করা ঠিক হবে না। যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন কমপক্ষে ছয়টি বিভাগকে সামনে রেখে তদন্ত করা হয়। এর মধ্যে পয়েন্ট সিগন্যাল ছাড়াও রয়েছে ট্রেন চালকদের অসচেতনতা, স্টেশন মাস্টারের ভুল নির্দেশনা এবং রেললাইনে কাজ করা প্রকৌশল বিভাগ। রেললাইনের কাজে অনেক সময় ত্রটিপূর্ন করে থাকে।