ঝিনাইদহ কালীগঞ্জে কৃষকের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে গড়ে তুলেছেন নৈশবিদ্যালয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০০ কৃষককে পড়ালেখা শিখিয়েছেন নৈশ্য বিদ্যালয়ে। সর্ব প্রথম নাইট স্কুল করেন ২০১৪ সালে এবং এ পর্যন্ত ১৯ টি নাইট স্কুলের কার্যক্রম শেষ করেছেন। সর্ব শেষ নাইট স্কুল পরিচালনা করছেন খড়কিডাংগা গ্রামে। তার বাবা ও ১৯৭১ সালে হারিকেল জালিয়ে বয়স্ক শিক্ষা দিয়ে বেড়াতেন। তার বাবা কাজী ওয়াহেদ দীর্ঘ ১৫ বছর বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তিনি ১৯৯১ সালে মারা যান। করা হয়েছে কাজী আবদুল ওয়াহেদ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন। এখানে ২১ জন সদস্য রয়েছে তারা প্রতি বছর ইউনিয়নের বিভিন্ন ঐলাকায় তালের গাছ, ওষধি গাছ,রক্ত পরিক্ষা, ডায়াবেটিক পরীক্ষা, কৃষকদের মাতাল দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ করে থাকে। সামাজিক দায়বদ্ধতার আরৈাকে মানুষের কল্যানের জন্য কাজ করছে ও সমাজের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এমদাদের নাইট স্কুল প্রতিদিন সন্ধা ৭ টা থেকে রাত ৮ টাপর্যন্ত বয়স্ক শিক্ষা দেওয়া হয়। বর্তমানে ৩৫ জন জন শিক্ষা নিচ্ছে। সমাজ উন্নয়ন ও পরিবর্তন করার জন্য শীত কালে খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ কারী গাছিদের সমাবেশ করে ১০০ জনকে নিয়ে। তিনি একটি প্রাইমারি স্কুল করার জন্য ৩৩ শতক জমি দিয়েছেন।
কামালহাট গ্রামের ইসমাইল হোসেন বলেন, কাজী এমদাদ ব- কলম থেকে এলাকায় বহু মানুষের নাম স্বাক্ষর করা শিখিয়েছেন। সে সামাজিক কাজ করে পায়ে হেটে ও বাইসাইকেল চালিয়ে।
জমিতে রাসায়নিকের ব্যবহার কমাতে কেঁচো সার তৈরির পরামর্শ ও প্রশিক্ষন দেন। কৃষকের রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ে সহায়তা করেন। বিতরণ করেন গাছের চারা। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কৃষকের কল্যাণে, বন্ধুর মতো পাশে থেকে কাজ করে চলেছেন মানুষটি। তিনি হলেন কাজী এমদাদুল হক। বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে। তিনি নিজেও একজন কৃষক। আবার শিক্ষকতা করেন গ্রামের একটি এবতেদায়ি মাদ্রাসায়। সেখানে বেতন নেই। বাড়িতে ছাত্র পড়িয়ে আর কৃষি কাজের আয়ে চলে সংসার। সেখান থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে কৃষকের কল্যাণে ব্যয় করেন। এলাকায় রয়েছে তার ব্যাপক সুনাম, একডাকে সবাই তাকে ভালবাসে। আবার এলাকায় কার ও ছোট খাট বিপদ হলে তিনি হলে তিনি এগিয়ে যান সাখানে। সব সময় মিষ্ট ভাষায় কথা বলেন সবার সাথে।
এমদাদুলের বাবা প্রয়াত কাজী আবদুল ওয়াহেদও কৃষির পাশাপাশি সামাজিক কাজে জড়িত আছেন। এলাকার লোকজন আজও তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। আর তা দেখে বাবার মতো মানুষের জন্য কিছু করার ভাবনা তাড়িত করত এমদাদুলকে। ২০০৬ সালের কথা। একদিন বাড়িতে কয়েকজন প্রতিবেশীকে নিয়ে বসেন। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। পাড়ায় পাড়ায় কৃষকদের নিয়ে রাতে বৈঠক শুরু করেন। পরে বৈঠক গুলোতেই পাঠদানের ব্যবস্থা করেন। এরপর একে একে জড়িয়ে পড়েন কৃষকের নানা সমস্যা সমাধানের কাজে।শুরুর দিকে এমদাদুল তাঁর নিজ ইউনিয়ন কোলার ১৫টি গ্রামে মাঠ ঘুরে কৃষকের তালিকা করেন। যাঁরা মাথায় মাথাল ব্যবহার করেন না এবং কীটনাশক ছিটানোর সময় মুখে মাস্ক দেন না, তাঁদেরও তালিকা করেন। সেই তালিকা ধরে তিনি কৃষকদের হাতে মাথাল ও মাস্ক তুলে দেন। এমদাদুল জানান, ইতোমধ্যে তিনি ৩ হাজারের বেশি মাথাল কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। মাস্ক দিয়েছেন ৫ হাজার। ‘মাথাল ছাড়া মাঠে কাজ করতে দেখলে এমদাদ ভাইয়ের মাথা ঠিক থাকে না। ছুটে গিয়ে ওই কৃষকের মাথায় মাথাল পরিয়ে দেন।’তিনি এসব নিজ টাকায় ক্রয় করে কৃষকদের মাঝে বিতারন করেন। পাখি নিধন বন্ধ করনের জন্য গ্রামে গ্রামে গ্রামে মাটির পাতিল, ফেষ্টুন,ব্যানার দিয়ে সচেতনাসুলক সমাবেশ করেন। করোনা ভাইরাসের সচেতনার জন্য ৪ গ্রামে সারান বিতারন করেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কৃষœচুড়া গাছ রোপন করেছেন। কামালহাট গ্রামে একটি কৃষি পাঠাগার করেছেন।
কৃষকদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এমদাদুল দেখতে পান, অক্ষরজ্ঞান না থাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন তাঁরা। কৃষি বিভাগ থেকে দেওয়া পরামর্শ দ্রুত ভুলে যান কৃষকেরা। লিখতে না পারায় কোনো কিছুই ধরে রাখতে পারেন না তাঁরা। তাই পাড়ায় পাড়ায় নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন। এখন পর্যন্ত ১৯ টি গ্রামে ১৯টি কেন্দ্রের মাধ্যমে ৫ হাজার কৃষককে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন করে তুলেছেন। এই কাজে গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলো তিনি ব্যবহার করেছেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে একটি কক্ষ ব্যবহার করে স্কুল চালিয়েছেন।এমদাদুল হক বলেন, অনেক কৃষক মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে নিজের শরীরটা ভালো ভাবে পরিষ্কার করেন না। রাতে মশারি খাটিয়ে ঘুমান না। এসব অসচেতনতা দূর করতে তিনি কৃষকদের মধ্যে সাবান ও মশারি বিতরণ শুরু করেন। এখন অনেক কৃষকই সাবান ব্যবহার করছেন। স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে এমদাদুল নিজে কেঁচো সার তৈরির প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন।
কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহিদুল করিম বলেন, তাঁর কাজ দেখে স্থানীয় কৃষি বিভাগ মুগ্ধ। তাই তাঁরা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এমদাদুল হকের বাড়িতে একটি কৃষি পাঠাগার করে দিয়েছেন। সেখানে একটি আলমারিসহ বেশ কিছু বইও দিয়েছেন তাঁরা।এ ছাড়া এমদাদুল কৃষকদের চিকিৎসা সহায়তায় রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে আসছেন। তিনি এলাকায় ৫০ হাজারের বেশি বনজ ও ফলদ গাছ এবং ৩৫ হাজার তালের আঁটি রোপণ করেছেন। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে বেতন পান না বলে বাড়িতে ছাত্র পড়ান। অনেক ছাত্র ছাত্রীদের ফ্রি পড়ান।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কমকতা সুবর্ণা রানী সাহা তো ভূয়সী প্রশংসা করলেন এমদাদুল হকের। তাঁর কথায়, ‘আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছেন যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এঁরা সাদামনের মানুষ। কাজী এমদাদুল হকও তাঁদের একজন।’