জীবন মানে যুদ্ধ। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে মানুষকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এমনি এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী রয়েছে গোমস্তাপুর উপজেলায়। পরিবারকে দু'মুঠো ভাত দেয়ার জন্য পথে-ঘাটে বাজারে বসে গান করে থাকেন। তিনি দু'পায়ে কলসকে রেখে বাদ্যযন্ত্র করে গান করে থাকে। তার কন্ঠের গান শুনে দর্শক খুশি হয়ে যা দেয় সেটা পেয়ে কোনমতে তার সংসার চলে। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালা ইউনিয়নের নন্দলালপুর গ্রামের আবদুল জব্বারের ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মিজানুর রহমান মিজান (৩৫)।
এ বিষয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মিজান বলেন, জন্ম থেকে তিনি দৃষ্টিভঙ্গি। তার সংসারে স্ত্রীসহ দু'টি ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে। অভাবী সংসার তার। তার দেখার কেউ নাই। হাটে-বাজারে গান করে যে টাকা পায় তা দিয়ে আমার সংসার চলে। এ ছাড়া হাটে-বাজারে গান করে দর্শকের কাছে যে টাকা পায় তা দিয়ে আমার সংসার চলে। তার দু'ইটা ছেলে ও একটি মেয়ে। বড় ছেলে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে, একমাত্র মেয়ে ৩য় শ্রেণীতে ও ৫ বছর একটি ছোট ছেলে রয়েছে। ছেলে-মেয়েদের চাওয়া-পাওয়া কখনও পূরণ করা সম্ভব হয়না এ রোজগারের টাকা দিয়ে। পাড়া প্রতিবেশী মাঝে মধ্যে সহযোগীতা করে থাকে। অনেক সময় এগিয়ে আসেনা। কান্না জনিত কন্ঠে তিনি বলেন কি করবো! মহান আল্লাহ আমাকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সবার সাথে মিলেমিশে চলাফেরা করি। যেহেতু তিনি দুটি চোখে দেখতে পায় না এইসব গান কেমন করে আয়ত্ত করেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মহান আল্লাহ তার দু'টা চোখের দৃষ্টি না দিলেও, যেকোন গান ১ থেকে ২ বার শুনার পর মেধায়শক্তি দিয়ে গানটি মুখস্ত করে থাকি। আর ওই গান জনগণের মাঝে পরিবেশন করে থাকি। তিনি এখন পর্যন্ত ২০০-২৫০টি গান গাইতে পারেন। গানগুলো বিভিন্ন সময় বাস ও যানবাহনে গেয়ে থাকি। তাছাড়া রহনপুর, সোনাইচন্ডী, নাচোল, কানসাট, খাসেরহাট ও মনাকষাসহ দেশের অন্যান্য হাটবাজারে টাকা উপার্জনের জন্য গান করতে যায় এবং জেলার বাইরেও কুয়াকাটা, যশোরের দর্শনাতে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে গান করেছ। তিনি স্থানীয় এফএম রেডিও মহানন্দাতে গান করেছেন বলে জানান। মিজান বলেন, করোনাকালীন তার পরিবার খুব কষ্টে দিনযাপন করছে। দেখার মত কেউ নেই। সরকার কর্তৃক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভাতা মাসিক ৭'শ টাকা করে পেয়ে থাকে। তার একসময় স্বপ্ন ছিল বড় শিল্পি হওয়া। বর্তমানে অভাব অনটনের সংসারে চালাতে দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। কেউ যদি তাকে সহায়তা করত তাহলে এলাকায় একটি দোকান দিয়ে পরিবারের মুখে দু’মুঠো ভাত ভাল করে তুলে দেয়াসহ ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতেন।।
প্রতিবেশী আতাজুল ইসলাম বলেন, জন্ম থেকেই মিজানকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে দেখে আসছি। সে প্রতিনিয়ত হাটবাজারে কলস বাজিয়ে গান করে জনগণকে মনোরঞ্জন দিয়ে টাকা উপার্জন করে। কেউ এক টাকা, দুই টাকা,পাঁচ টাকা, কেউ দশ টাকা করে যে টাকা পায় সে টাকা দিয়ে তার সংসার চালান। তার বাড়ির পাশে একটা ভাঙ্গাচোরা বাড়ি আছে। সে বাড়িতে স্ত্রী,সন্তান নিয়ে বাস করছেন মিজান। গ্রামের মানুষ যতটুকু পারে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকি। তিনি আরও বলেন, হাট-বাজারে গান পরিবেশন করে মিজান ২৫০ থেকে ৩০০'শ টাকা উপার্জন করে থাকে। যানবাহন উঠলে তাকে ভাড়া লাগে না। লোকজন তার মধুর আচরণের মুগ্ধ।
চৌডালা বাজার এলাকার মাইনুল ইসলাম মিজান সম্বন্ধে বলেন, সে খুব সুন্দর সুন্দর গান শোনায়। কেমন করে এসব গান আয়ত্ত করে এ প্রশ্ন জনসাধারণের মনে জাগে? তাকে মিজান বলেছেন, যে গান একবার সে শোনে সে গান নাকি তাকে আর দ্বিতীয়বার শুনা লাগেনা। তার কন্ঠটাও খুব সুন্দর তাই দর্শকরা মনোয়োগ দিয়ে তার গান শুনে থাকেন। তার গানে খুশি হয়ে অনেকে আবার বেশি টাকাদিয়ে থাকে।
এ বিষয়ে চৌডালা ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আলম বলেন, মিজানুর রহমান একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তার একটি প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড আছে। তার একটা কর্মসংস্থানের করে দেয়া যায় সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদ চিন্তা করছে।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মিজানের কর্মজীবন বিষয়ে অবগত আছি। উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে পরবর্তীতে সহায়তা করা হবে।