পড়ালেখার পাশাপাশি হাতপাখা তৈরি আর ভ্যানের চাকা ঘুরিয়ে সংসার চালাচ্ছে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের কলেজ ছাত্র জুয়েল রানা। সে অসহায় দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এখন সে এইচএসসি পরীক্ষার্থী। পাখা তৈরি ও ভ্যান চালিয়ে সংসার চালিয়ে পরিবারের জীবিকা নির্বাহ তাদের একমাত্র ভরসা।
পিতৃহীন জুয়েল পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যস্ত সময় পার করছে তালপাখা তৈরির কাজে। এখন তালপাখার মৌসুম, তাই দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে সে। এই কাজে তার মা শেফালী বেগমও সহযোগিতা করে অধিক সময়। এবছর ১৯ হাজার তালপাখা তৈরি করেছে, ইতোমধ্যে দুই হাজার বিক্রিও হয়েছে। অবশিষ্ট পাখা বাড়িতে রেখেছে পাইকারি হিসাবে বিক্রি করার জন্য।
হতদরিদ্র ছেলেটি বাড়িতে হাতপাখার পাশাপাশি বাবা মিন্টু সর্দারের রেখে যাওয়া ভ্যান নিয়েও বাইরে বের হয়। ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪,শ টাকা আয় হয়। যা দিয়ে তাদের চারজনের সংসার চলে কোন ভাবে। তালপাখা বিক্রির টাকায় পড়ালেখার খরচ চালিয়ে, কিছু টাকা জমিয়ে রাখে ভবিষ্যতের জন্যে। জুয়েল রানা ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার পারিয়াট গ্রামের মিন্টু সর্দ্দারের ছেল।
প্রতি বছর এই সময়ে তাদের গ্রামে তালপাখা তৈরির ধুম পড়ে, বাজারে এর চাহিদাও অনেক বেশি থাকে। এই পাখা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়িরা নিয়ে বিক্রি করে থাকে।
পারিয়াট গ্রামের জুয়েল রানার মা শেফালি বেগম পাখা তৈরির কাজ করছিল সে সময়ে জুয়েল ভ্যান নিয়ে ভাড়া মারতে গেছে। খবর নিয়ে জানা যায় জুয়েল রানা পাশের একটি বাজারে মালামাল নিয়ে ভাড়া নিয়ে গেছে। শেফালী বেগম বলেন, ছেলেটা দিন-রাত পরিশ্রম করে। আবার লেখাপড়া ও করছে। স্বামীর মৃত্যুর পর জুয়েলই সংসারটা টিকিয়ে রেখেছে।
তালপাখা তৈরির ব্যাপারে জানতে চাইলে জুয়েল রানা জানায়, তাদের গ্রামে কমপক্ষে ২০টি পরিবার হাতপাখা তৈরির কাজ করে। পাখা তৈরি তাদের পেশা ও পরিবার পরিজন নিয়ে জিবিকা নির্বাহ করে থাকে। জুয়েল রানার বাবা ভ্যান চালানোর পাশাপাশি পাখা তৈরি করতেন। অভাবের সংসার হওয়ায় ছোট অবস্থায় পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার কাজে সহযোগিতা করতো। এখান থেকেই কাজ শিখেছে রানা।
২০১৯ সালের ১৫ জুন বাবা মিন্টু সর্দারকে একটি গরু শিং দিয়ে সজোরে আঘাত করলে তিনি আহত হন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান। এরপর থেকে পরিবারের সব দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। জুয়েল রানা আরো জানান, ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে সেপ্টেম্বর মাসের দিকে গাছ থেকে পাতা কাটতে হয়। উঁচু গাছে উঠে সে ও পাতা কাটে। বাড়িতে এনে সাইজ করে রাথে তাল পাতা। তারপর বান্ডিল বেঁধে ফেলে রাখেন। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস এলেই পাখা তৈরি শুরু হয়। বান্ডিল থেকে পাতা খুলে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে আবার শুকিয়ে নিতে হয়। অনেক পাখা নকশা তৈরি আর সেলাই করতে হয়। মাঝে বাঁশের শলাকা তৈরি করা রং লাগানো এভাবে তালপাখা তৈরি করে থাকে।
একটি পাখা তৈরিতে খরচ হয় ৮ থেকে ৯ টাকা। যা বাজারে ১৫ থেকে ১৮ টাকা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি করে থাকে। খুচরা বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ টাকা। এ বছর ১৯ হাজার পাখা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, যার মধ্যে কিছু সম্পন্ন হয়েছে; কিছু পাখার সামান্য কাজ বাকি আছে। এ বছর লক্ষাধিক টাকার পাখা বিক্রি করবে বলে আশা করছে।
বাবার মৃত্যুর পর সংসার কাঁধে নিয়েই এসএসসি পরীক্ষা দেয়। মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৩.৮৭ পেয়েছে। ঝিনাইদহ সদরের নারিকেলবাড়িয়া আমেনা খাতুন ডিগ্রী কলেজে লেখাপড়া করছে। এইচএসসি পরীক্ষাতেও ভালোভাবে পাশ করবেন এমন আশা রয়েছে।
প্রতিদিন সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, একটা নিয়মিত ভাড়া আছে সেখানে। দুপুর পর্যন্ত ভ্যান চালায়। বিকেলে পাখা তৈরি আর রাতে পড়ালেখা। তারা তিন ভাই, বড় ভাই রানা ইসলাম (২১) শ্যালো ইঞ্জিনভ্যান (লাটা) চালান। এতে যা পান তা তারই দৈনন্দিন খরচ হয়। আর ছোট ভাই আরাফাত সর্দার (১২) পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ছে।
পুঁজি না থাকায় বেশি পাখা তৈরি করতে পারেন না। ৩০ হাজার টাকা নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
মা শেফালি বেগম জানান, বাবার মৃত্যুর পর ছেলেই সংসারের হাল ধরেছে। বড় ছেলে তেমন একটা আয় করতে পারে না। দুই কক্ষের টিনের ঘরে বসবাস করে। কষ্টে চলে তাদের সংসার। আশা করছেন, ছেলে পড়ালেখা শিখে একটা চাকরি পেলে কষ্ট দূর হবে। কিন্তু সংসার চালাতে এত কাজ যার কাঁধে, সে পড়ালেখায় ভালো করতে পারবে কি না।