ফরিদপুরের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক জগদীশ চন্দ্র ঘোষ তারাপদ স্যারের শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই প্রবীনের অন্তিম যাত্রার প্রাক্কালে তার কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রতিনিধিত্বশীল ব্যাক্তিবর্গ।
শনিবার দুপুরে ফরিদপুর শহরের অম্বিকাপুর শ্মশানে তর শেষ কৃত্য অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এর আগে ফরিদপুর প্রেসক্লাব চত্বরে ঘন্টাব্যাপী সর্বস্তরের মানুষ তাকে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করে। শুক্রবার দিবাগত রাতে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনায় মারা যান তারাপদ স্যার।
শহীদ পরিবারের সন্তান জগদীশ চন্দ্র ঘোষ ১৯২৮ সালের ৬ আগস্ট মানিকগঞ্জের কাঞ্চনপুর গ্রামে মাতুতালয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা শহীদ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, মা প্রফুল্ল বালা ঘোষের জেষ্ঠ্য সন্তান তিনি। ফরিদপুরের বেশিরভাগ মানুষ তাঁকে চিনেন তারাপদ স্যার নামে।
১৯৭১ সালের ২ মে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় জগদীশ চন্দ্র ঘোষের পরিবার। ফরিদপুর সদরের ঈশান গোপালপুরে জমিদার বাড়ির সেদিনের হত্যাযঞ্জে যে ২৮ ব্যক্তি শহীদ হন তাদের মধ্যে ছিলেন তাঁর পিতা যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, ভাই গৌর গোপাল ঘোষ, কাকাতো ভাই বাবলু ঘোষ প্রমুখ।
ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর ১৯৫০ সালের দিকে জগদীশ চন্দ্র ঘোষ ডাকবিভাগের একটি ব্রাঞ্চ অফিসে পোষ্ট মাস্টার হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিন পর চর নসিপুর প্রাইমারী স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে জগদীশ চন্দ্র ঘোষ গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৯৫ সালে ফরিদপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। ৬০’র দশকে প্রথমে দি পাকিস্তান অবজারভার ও পরে দি বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। দীর্ঘ ৪০ বছর তিনি দি বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অকৃতদার জগদীশ চন্দ্র ঘোষ শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার পাশাপাশি ফরিদপুর টাউন থিয়েটারের কর্ণধার হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
২০০৩ সালে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি ফরিদপুর জেলা ইউনিটের শহীদ সাংবাদিক সামসুর রহমান স্বর্ণপদক লাভ করেন। ২০১৩ সালে তাঁকে সমকালের উদ্যোগে সাংবাদিক গৌতম স্মৃতি পদক প্রদান করা হয়। ২০০৫ সালে ডাচবাংলা ব্যাংক-প্রথম আলোর উদ্যোগে ফরিদপুর অঞ্চলের গণিত উৎসবে তাঁবে বিশেষ ভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়। ২০১৯ সালে তিনি আইপিডিসি-প্রথম আলো সেরা প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা লাভ করেন।
শনিবার সকাল ১০টার দিকে জগদীশ চন্দ্র ঘোষের মরদেহ একটি পুস্পশোভিত কাঁচ ঘেরা গাড়িতে করে (স্বর্গরথ) ফরিদপুর প্রেসক্লাব চত্ত্বরে আনা হয়। সেখানে তার প্রতি অন্তিম শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে যান ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার, পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান, প্রফেসর এমএ সামাদ, ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতির সাধারন সম্পাদক ডা. আসম জাহাঙ্গীর চৌধুরী টিটো, ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি কবিরুল ইসলাম সিদ্দিকী, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল হক, ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র অমিতাভ বোস, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য সচিব আইভি মাসুদ, ফুলকির সভানেত্রী অঞ্জলি বালাসহ সমাজের সর্বস্তরের ব্যাক্তিবর্গ।
প্রিয় স্যারের প্রতি ফুলের শুভেচ্ছা জানায় ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারন সম্পাদক পান্না বালা, দৈনিক সমকাল প্রত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক হাসনউজ্জামান, সমকাল সুহৃদ সমাবেশের সভাপতি সৌমিত্র মজুমদার পলাশ, সাধারন সম্পাদক কাজী সবুজ, প্রথম আলো বন্ধু সভার সভাপতি সুজিত কুমার দাস ও সাধারণ সম্পাদক মানিক কুমার, ফরিদপুর টাউন থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত দাস, ফরিদপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান, সহকারি প্রধান শিক্ষক শামীমা শিমু প্রমুখ।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জগদীশ চন্দ্রের মরদেহবাহী গাড়িটি যখন মুজিব সড়ক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ফরিদপুরের অম্বিকাপুর শ্মশান ঘাটের উদ্দেশ্যে তখন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সর্বস্তরের লোকজন সে শবযাত্রা অনুসরণ করে। কেউ বা গাড়িতে করে কিংবা কেউ বা পায়ে হেঁটে।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অম্বিকাপুর মহা শ্মশানে জগদীশ চন্দ্র ঘোষের শেষকৃত্য শুরু হয়। দুপুর দেড়টায় কুমার নদের পানি দিয়ে চিতার আগুন নিভিয়ে ফেলার মধ্যে দিয়ে অনন্ত পথের যাত্রী হন ফরিদপুরের বাতিঘর জগদীশ চন্দ্র ঘোষ।