নগর জীবনের মেলানকোলি উঠে এসেছে একটি খুনের তদন্তে। দু'জনেই তরুণ চিকিৎসক। আত্মহত্যার চেষ্টার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মেয়েটি। নিয়মিত দেখা করে মানসিক সমর্থন যোগাচ্ছেন ছেলেটি। ক'দিনের মধ্যেই গড়ে ওঠে প্রেম। শুরু হয় লিভ টুগেদার। দ্রুতই সন্দেহ-অবিশ্বাসে বিষিয়ে ওঠে সম্পর্ক। মনোমালিন্যের জেরে ফের আত্মহননের পথে। তখনই নিস্তেজ প্রেমিকাকে হত্যার পর, সাজানো সুইসাইড নোট লিখে, আত্মহত্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা প্রেমিকের। নগর জীবনের এই মেলানকোলি উঠে এসেছে একটি খুনের তদন্তে।
পরিচয়। সম্পর্ক। লিভ টুগেদার। ভালবাসার বদলে ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ। ঘাত-প্রতিঘাতের পরম্পরায় প্রেমিকার আত্মহত্যার চেষ্টা। প্রেমিকের মনে তখন যেন শেক্সপিয়রের হেমলেশীয় দ্বিধা- প্রিয়তমাকে বাঁচাবে নাকি হত্যা করে সম্পর্ক থেকে বেরোবে!
চীনের নানচাং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএসের পাঠ চুকিয়ে ২০১৮ সালে দেশে ফেরেন এই জীবনগল্পের দুই চরিত্র এস এম রাকিবুল আজাদ ইমরান ও সিরাজুম মনিরা সোমা। শিক্ষানবিশ পর্ব শুরু করতে দুজনেই অংশ নেন বিএমডিসি কোয়ালিফাইং এক্সামে। পাস করেন ইমরান। ফেল করার পর সোমার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে পরিবারের। বিষন্নতায় আত্মহননের চেষ্টা করে মেয়েটি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সোমাকে প্রায়দিনই দেখতে যান ইমরান। যোগান মানসিক সমর্থন। বেঁচে ফেরে সোমা। হয়ে যায় দুজনার প্রেম। পরের বার বিএমডিসির পরীক্ষায় পাস করার পর একই হাসপাতালে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দেন তারা। খিলক্ষেতে বাসা ভাড়া নিয়ে শুরু করেন লিভ টুগেদার।
প্রেমিকা হত্যা মামলার আসামি ডা. এস এম রাকিবুল আজাদ ইমরান বলেন, "কথা কাটাকাটির কিছু ব্যাপার ছিল, সন্দেহের কিছু ব্যাপার ছিল। ও অতিরিক্ত রগচটা ছিল। যেকোনো বিষয় নিয়ে অনেক বেশি সমস্যা হত।"
পরস্পরকে সন্দেহ-অবিশ্বাসের মধ্যে ২০১৯ এর মার্চে অন্তঃসত্তা হলেও স্বীকৃত সম্পর্ক না থাকায় গর্ভপাত করান সোমা। এ নিয়ে তীব্র বিষন্নতা, সঙ্গে ইমরানের প্রতি সংশয়ে ওদের সম্পর্কের ফাটল কেবল চওড়া হতে থাকে। এবছরের তেইশে জানুয়ারি চূড়ান্ত মনোমালিন্যের পর আলাদা কক্ষে চলে যান সোমা। বন্ধ হয়ে যায় দু'জনের যোগাযোগ। পরদিন রাতে দোকান থেকে পলিথিনে ভরে রুটি কলা কিনে আনেন ইমরান। ২৫শে জানুয়ারি ভোরে সোমার কক্ষে ঢুকে দেখেন- অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ সেবন করে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে প্রেমিকা। তখনই হেমলেশীয় দ্বিধা কাটিয়ে খুনি হয়ে ওঠেন তরুণ চিকিৎসক।
ডা. এস এম রাকিবুল আজাদ ইমরান বলেন, "পলিথিনের যে ব্যাগ সেটা মাথায় দিয়ে টেপ দিয়ে পেঁচিয়ে দিলাম। আর হাতে টেপ মেরে দিয়ে চলে এসেছিলাম। পরে একটা ফিল আসলো কি করলাম। পরে দৌড়ে গিয়ে টেপ ছিড়ে দেখি ও নেই। যেকোনো মানুষ অপরাধ করলে স্বীকার করবে না। আমি একই, আমিও তো মানুষ।"
সাজানো সুইসাইড নোট লিখে প্রেমিকার মরদেহের পাশে পাঁচঘণ্টা বসে থাকেন ইমরান। তারপর সকাল দশটার দিকে বাড়ির মালিকের ছেলেকে জানান, সোমার আত্মহত্যার সাজানো প্লট।
বাড়ির মালিকের ছেলে ফাহাদ বিন হাসনাতকে ইমরান জানিয়েছিল সোমা আত্মহত্যা করেছে।
থানা পুলিশের হাত ঘুরে তদন্তের ভার আসে গোয়েন্দা পুলিশে। বেরিয়ে আসে রহস্য- আত্মহত্যা নয়, সোমাকে হত্যা করেছে ইমরান। আদালতে স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন খুনের দায়ে অভিযুক্ত প্রেমিক।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (গুলশান) উপ কমিশনার মো. মশিউর রহমান বলেন, " হত্যাকাণ্ড করতে গিয়ে সে অনেকবার দ্বিধান্বিত হয়েছে। যেটাকে আমরা শেক্সপিয়ারিয়ান হেমলেশিয়ান ডিলেমার সাথে তুলনা করতে পারি।"
ইমরান-সোমার পরিণতি হয়ে ওঠে নগরজীবনের মেলানকোলি।