চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। অথচ এই নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে কয়েকটি চোরাই সিন্ডিকেট। আমদানিকৃত তেল, স্ক্র্যাপ, কয়লা, গম, ভুট্টা, সয়াবিজ চোরাইয়ে জড়িত রয়েছে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। এরইমধ্যে এসব সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করেছে নৌ-পুলিশ। এসব চুরির সাথে শুধু জাহাজের মাস্টার সুপারভাইজার নয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও জড়িত আছে। এরইমধ্যে এই ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন সিন্ডিকেটগুলো। অভিযোগ উঠেছে- তারা পুলিশকে মাসোয়ারা দিয়ে প্রকাশ্যে নদী পথে চোরাইপণ্যের ব্যবসা করছেন। তবে সদরঘাট নৌ থানার ওসি এবিএম মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমদানিকৃত পণ্যের চোরাই বন্ধে কর্ণফুলী নদীতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যারা আগে থানার ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচয় দিতো তাদের নৌ-থানা এরিয়ায় কঠোরভাবে অবাঞ্ছিত করা হয়েছে।
পুলিশ ও ¯’ানীয় এলাকাবাসী সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম প্রধানতম সমুদ্র বন্দর হওয়ায় দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগ আমদানি-রপ্তানি পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণ হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই। আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে একটি বিরাট অংশ বাল্ক জাহাজ করে আমদানি হয়। পরে বহির্নোঙর থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় খালাস হয়। বাল্কবাহী জাহাজে আসা পণ্যের মধ্যে স্ক্র্যাপ, কয়লা, সার, গম, সয়াবীজ, ভুট্টা আমদানি বেশি হয়। খোলা জাহাজে আমদানির সুযোগে বহির্নোঙরের মাদার ভ্যাসেল থেকে এবং লাইটারিংয়ে নিয়োজিত লাইটার জাহাজ থেকে আমদানিকৃত এসব পণ্য চোরাইয়ের সাথে জড়িত কর্ণফুলী নদীকেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি চোরাই সিন্ডিকেট। বিগত কয়েক মাসে এসব সিন্ডিকেটগুলোকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। চিহ্নিত এসব চোরাই সিন্ডিকেটের মধ্যে জাহাজের মাস্টার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরাও রয়েছেন। বেশ কয়েকটি অভিযানে চোরাইপণ্যসহ কমপক্ষে ৬টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা, একটি ট্রাকও জব্ধ করা হয়। চোরাই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। নৌ-পুলিশ গত ৩০ সেপ্টেম্বর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চোরাই স্ক্র্যাপ বহন করার সময় কর্ণফুলী নদীর ইছানগর ডায়মন্ড সিমেন্ট ঘাটের সামনে থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা আটক করে। ওই অভিযানের সময় কয়েকজন পালিয়ে গেলেও পুলিশ সদস্যরা নৌকা থেকে জাহাঙ্গীর আলম, আবু বক্কর ছিদ্দিক, মো. শামীম, মো. মাসুদ, মো. সাগর ও জাকির হোসেনসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় নৌকা থেকে দেড় টন আমদানিকৃত চোরাই স্ক্র্যাপ লোহা জব্ধ করা হয়। এরপর চোরাই চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, স্ক্র্যাপগুলো ‘এমবি সী-মুন’ নামের স্ক্র্যাপ বাহী লাইটার জাহাজ থেকে জাহাজের মাস্টার ও এস্কট পার্টির লোকজনের যোগসাজশে বিক্রির জন্য নেওয়া হ”িছল। এই চুরির সাথে কর্ণফুলী উপজেলার চোরাই পণ্য ব্যবসায়ী ইব্রাহীম প্রকাশ কালু সওদাগর, ‘এমবি সী-মুন’ জাহাজটির মাস্টার নাজিম উদ্দিন ও জিএমএস ইন্টারন্যাশনাল নামের সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানের এস্কট জামালসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে কর্ণফুলী থানায় মামলা করে সদরঘাট নৌ-থানার এসআই আনোয়ারুল ইসলাম।
এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর ভোরে কর্ণফুলী নদীতে দুর্ঘটনায় ডুবে যাওয়া স্ক্র্যাপ বোঝাই ‘এমভি বর্নীয়-২’ জাহাজ হতে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে এসে চোরাইচক্রের ৫/৬জন স্ক্র্যাপ বোঝাই করে পালিয়ে যায়। পরে নৌ-পুলিশ অভিযান চালিয়ে দেখতে পায়, বাংলাবাজার এলাকায় নদীতে থাকা নৌকা হতে চোরাই স্ক্র্যাপগুলো যাত্রী ছাউনির পাশে অব¯’ান করা ঢাকামেট্টো-ট-১১-১০৫৭ ট্রাকটিতে বোঝাই করা হ”েছ। এ সময় পুলিশের উপ¯ি’তি টের পেয়ে চোরাইচক্রের সদস্যরা পালিয়ে যায়। পুলিশ ট্রাক ও নৌকা দুটিসহ দুইটন ৮০ কেজি স্ক্র্যাপ লোহা জব্দ করে। এই ঘটনায় চোরাই পণ্য ব্যবসায়ী কালু সওদাগর ও ইয়ার মোহাম্মদ নামের দুই জনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় মামলা করে নৌ-পুলিশ। গত ২২ সেপ্টেম্বর পুলিশ ভোরে অভিযান চালিয়ে বহির্নোঙর থেকে চোরাই আমদানিকৃত গমভর্তি করে আসা একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা কর্ণফুলী নদীর শাহমীরপুর বাল্যপুকুর এলাকা হতে আটক করে। এ সময় নৌকাসহ চোরাই দুইটন গম জব্দ করে নৌ-পুলিশ। পরে ¯’ানীয়দের সাক্ষ্যতে নৌ-পুলিশ মো. রু¯‘ম, মো. ইলিয়াছ, নুরুল হুদা, তুষার, নুর, এসকান্দর, ইসহাক, জাহাঙ্গীর, তাহের ও ইলিয়াছের নামে কর্ণফুলী থানায় মামলা করে। এর আগে ১৮ জুলাই বহির্নোঙর থেকে চুরি করে আনা এক টন করে সয়াবীজসহ দুইটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা কর্ণফুলী নদীর শাহমীরপুর বাল্য পুকুর এলাকা হতে আটক করে। এ সময় আজগর আলী নামের একজনকে আটক করে। পরে আটক আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদে মো. নুর, ইসকান্দর, জাহাঙ্গীর ও মো. ইসহাকসহ ৫ আসামির বিরুদ্ধে কর্ণফুলী থানায় মামলা দায়ের করে নৌ-পুলিশ। সর্বশেষ গত ৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে কর্ণফুলী নদীতে অভিযান চালিয়ে ভোজ্য তেলের অপরিশোধিত আড়াই হাজার লিটার ত্রুুড অয়েলবাহী একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা জব্দ করা হয়। একইসঙ্গে নৌ-পুলিশ সেলিম, সাদেক, আবদুর রহিম, ইব্রাহীম ও লোকমান নামের ৫জনকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় ৮ ডিসেম্বর কর্ণফুলী থানায় একটি মামলাও হয়।