একদিকে করোনা আরেকদিকে বন্যা। এর মধ্যে পড়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার উপক্রম পাবনার বেড়া উপজেলার তাঁতিদের।
করোনায় কাজ না থাকায় মাস তিনেক প্রায় সবাই তাঁতই বন্ধ রেখেছিলেন তাঁরা। ঈদুল আযহার হাটকে সামনে রেখে সপ্তাহ তিনেক আগে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ছিলেন। এজন্য সবাই কমবেশি তাঁত চালু করেছিলেন। কিন্তু সপ্তাহ খানেক আগে বন্যার পানি বৃদ্ধিতে উপজেলার মুজিববাঁধ তীরবর্তী বসবাস করা তাঁতিদের তাঁতঘরসহ বাড়ির বসতঘরগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে আত্মীয় বাড়িসহ অন্যের বাড়িতে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নিয়েছে এসব পরিবারের লোকজন।
অপরদিকে তাঁতে উৎপাদিত লুঙ্গি হাঁটে নিয়ে লাভের দেখা পাচ্ছিলেন না তারা।
গতকাল বোববার তাঁতি অধুষিত হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নে ঘুরে একাধিক তাঁতিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এবারের বন্যায় বেড়া উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে মালদাপাড়া, পেঁচাকোলা, উত্তর পেঁচাকোলা, রাকশা, সাফুল্যাপাড়া, বাটিয়াখরা, নেওলাইপাড়া, সোনাপদ্মা, রূপপুর, খানপুরাসহ তাঁত সমৃদ্ধ অন্তত ১৫টি গ্রাম রয়েছে। করোনার কারণে গ্রামগুলোর ১০ হাজার তাঁতশ্রমিক এমনিতেই ধুঁকছিলেন। বন্যা তাঁদের পথে বসিয়েছে। বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বসতঘরগুলোও। সবচেয়ে বড় কথা হলো পানিতে ডুবে থাকায় তাঁতযন্ত্রগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। এখন তাঁরা জীবন জীবিকা নিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছেন। তাঁতঘর, বসতঘর ও অকেজো তাঁত অন্যথায় সরিয়ে নেয়া ও মেরামতের চিন্তায়। এর সঙ্গে খাবার যোগাড়ের চিন্তা তো আছেই বলে তাঁতিরা জানান।
পেঁচাকোলা গ্রাম ঘুরে আরও দেখা যায়, হাতেগোনা দশ বারোটি তাঁত কারখানা এখনও একেবারে ডুবে যায়নি, কারখানার মধ্যে প্রায় হাঁটু পানি। পানির মধ্যেই লুঙ্গি তৈরীর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তবে দুই তিন দিনের মধ্যেই এসব কারখানা ডুবে যাবে বলে জানান তাঁতিরা।
এই গ্রামের ছলেমান তাঁতির সাথে তিনি বলেন, করোনার জন্নি এমনিতেই আমাদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়া গেছিল। শেষ সম্বল তাঁত দুইখান নিয়্যা বাঁচার আশা করিছিল্যাম। কিন্তু বন্যায় সেই আশাও শেষ হয়া গেল।
ছলেমানের মতো একই দশা বেড়ার বন্যাকবলিত সব তাঁতিদের। ঈদ মৌসুমে যেখানে তাঁতিদের কর্মব্যস্ত থেকে বাড়তি আয় করার কথা সেখানে তাঁরা লড়াই করছেন পানির সঙ্গে। করোনার কারণে গত ঈদুল ফিতরে বন্ধ ছিল উপজেলার বেশির ভাগ তাঁত কারখানাগুলো। ঈদুল আযহায় অল্প কিছু তাঁত চালু হলেও ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে বন্যা। তাঁতিদের অনেকেই নতুন করে মহাজন ও এনজিওসহ বিভিন্ন স্থান থেকে রং-সুতা কিনে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁতঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় তাঁদের তাঁতযন্ত্রই শুধু নষ্ট হয়নি, ঋণের টাকায় কেনা রং-সুতাও নষ্ট হয়েছে।
নেওলাইপাড়া গ্রামের রজব আলী আক্ষেপ করে বলেন, ঈদের হাঁটের কথা চিন্তা করে কয় দিন আমার পাঁচ খান তাঁত থেকে লুঙ্গি বুনাইয়ে বেড়া ও শাহজাদপুর বিক্রি করলাম। সপ্তাহখানেক হল তাঁত ঘড়ই ডুবে গেছে। ধার করে অনেক টাকার সুতা রং কিনছিলাম সব শেষ। বউ পোলাপান নিয়ে অন্যের বাড়িতে রইছি একেবারে সর্বস্বান্ত হয়া গ্যালাম। এখন পর্যন্ত সরকারি কোন সহযোগিতা পাননি বলেও তিনি জানান।
হাটুরিয়া-নাকালিয় ইউনিয়ন পরিষদের ৪নং (ইউপি) সদস্য সিল্টু মিয়া বলেন, আমার ৪নং ওয়ার্ডসহ ৫নং ওয়ার্ডের পেঁচাকোলা ও নতুন পেঁচাকোলা গ্রামে অন্তত পাঁচ-সাতশ তাঁতি পরিবার বন্যাদুর্গত। উপজেলায় অন্যান্য গ্রামে আরও হাজারের বেশি তাঁতিদের একই অবস্থা। করোনার পর বন্যার আঘাতে তাঁতিরা নিঃস্ব হওয়ার পথে।
ইউএনও আসিফ আনাম সিদ্দিকী বলেন, বন্যাকবলিত অসহায় তাঁতিদের বিষয়টি আমি অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখব। আসলে বন্যাকবলিতদের জন্য আলাদা কোনো ত্রাণ সহায়তা না এলেও ঈদ উপলক্ষে উপজেলায় বড় ধরনের ত্রাণ সহায়তা (ভিজিএফ) এর চাউল এসেছে। বন্যাকবলিত এলাকাতেই এগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেওয়া হবে। এর মধ্যে অসহায় তাঁতিদের ব্যাপারে আরও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।