শেরপুর জেলার অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র নালিতাবাড়ী উপজেলায় পোড়াগাঁও ইউনিয়নে ময়মনসিংহ বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় মধুটিলা ফরেষ্ট রেঞ্জের সমেশ্চুড়া বন বীটের আওতায় ৩৮০ একর বনভূমিতে সরকারীভাবে ২০০০ সালে নির্মিত হয় ‘মধুটিলা ইকোর্পাক’। স্থাপনের ২০ বছর অতিবাহিত হলেও এ পার্কটি এখনো পুর্ণাঙ্গ পার্কে পরিনত না হওয়ায় এর সৌন্দর্য এখন অনেকটাই ম্লান হতে চলেছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলেছেন ইতোমধ্যেই এই পার্কের আরো সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি ও পুর্ণাঙ্গ পার্কে রুপান্তরিত করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। অবস্থা খারপের দিকে গেলেও বিনোদন প্রিয় মানুষের আগমনের কমতি নেই। যেন বেড়েই চলছে। বর্তমানে র্পাকটিতে উপড়ে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে আকাঁবাকাঁ কালো পিচঢালা সীমান্ত হাইওয়ে রাস্তাটি নির্মিত হওয়ায় পর্যটক, যাত্রী সাধারন, এলাকাবাসীর জন্য এ এক দারুন উপভোগ্য মনোরম যাত্রা পথের নান্দনিক আরামদায়ক ভ্রমন পথে পরিনত হয়েছে। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নতুন রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পড়বে উঁচু নিচু পাহাড় আর সুন্দর রাস্তা। আকাঁবাকাঁ পথ পেরিয়ে যাওয়ার সময় উত্তরের পাহাড়ী জনপদে বসবাসকারী আদিবাসী জনসম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সুন্দর বাড়িঘরও চোখে পড়বে এবং পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে রোপিত ধান ক্ষেত, পাহাড়ী গাছ আর সবুজ পাহাড় মিলে এ এক দারুন উপভোগ্য বিষয়।
পর্যটন এলাকাটিতে যেভাবে আসা যায়ঃ শেরপুর জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার, নালিতাবাড়ী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার রাজধানী ঢাকা থেকে মধুটিলা ইকোপার্কের দুরত্ব প্রায় ২শ কিলোমিটার। ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ময়মনসিংহ হয়ে শেরপুর আসতে হবে। শেরপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে নালিতাবাড়ী উপজেলার নন্নী বাজার পর্যন্ত লোকাল বাস, লেগুনা, সিএনজি ও ইজিবাইক পরিবহন রয়েছে। এছাড়াও শেরপুর জেলা শহর থেকে ভাড়ায় সিএনজি অথবা মটরসাইকেলে মধুটিলা ইকোপার্কে আসা যায়। অথবা নিজস্ব গাড়ীতে সরাসরি ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে শেরপুর পৌঁছানোর আগে নকলা উপজেলা থেকে নালিতাবাড়ী নাকুগাঁও স্থলবন্দর সড়ক দিয়ে ইকোপার্কে আসা সহজ হয়। সব মিলিয়ে শীত মৌসুম ছাড়াও সম্ভাবনাময় এই ইকোপার্কে প্রায় সাড়া বছরই দেশি-বিদেশি পর্যটক ও ভ্রমন পিয়াসীদের ভীড় লেগেই থাকে।
এই পার্কটির প্রধান ফটক পেড়িয়ে ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে হাতের বামপাশে চোখে পড়বে ডিসপ্লে মডেল, তথ্যকেন্দ্র ও সারি সারি গাছ। রাস্তার ডান পাশে গাড়ী পাকিং জোন আর দু-পাশে রকমারি পণ্যের দোকান। সামনের ক্যান্টিন পার হলেই পাহাড়ী ঢালু রাস্তা। এরপরই হাতি, হরিণ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, বানর, কুমির, ক্যাঙ্গারু, মৎস্য কন্যা, মাছ, ব্যাঙ, কুমির ও পশু-পাখির ভাষ্কর্য। পাশের আঁকাবাঁকা পথে ঘন গাছের সারি লেকের দিকে চলে গেছে। তারপর ষ্টার ব্রিজ পেরিয়ে পাহাড়ের চুড়ায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে আরোহণ করলেই নজর কেড়ে নেয় ভারতের উঁচু নিচু পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। রয়েছে ক্যান্টিন, মিনি চিড়িয়াখানা, বন্য প্রাণি বিরল প্রজাতির পশু-পাখির ভাষ্কর্য। আরো আছে ঔষধি ও সৌন্দর্য বর্ধক প্রজাতির বৃক্ষ এবং ফুলসহ বিভিন্ন রঙের গোলাপের বাগান। প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন ভ্রমন পিয়াসীরা। সারাদিন প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে কর্মক্লান্ত ভ্রমন পিয়াসীরা আনন্দ নিয়ে ফিরে যান নিজ গৃহে।
বন বিভাগের মধুটিলা ইকোপার্কের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুল করিম জানান, ২০০৯ সালে এ পার্কের আরো সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য ঝুলন্ত ব্রিজ, লেক এক্সটেনসহ পার্কটির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য ২ কোটি ৮০ লাখ টাকার প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত অনুমোদন না হওয়ায় আবার ২০১৯ সালে লেক এক্সটেন, ৬ কিলোমিটার বাউন্ডারী দেয়াল নির্মাণ, হরিণ ও বন্য প্রাণি রাখার জন্য মিনি চিড়িয়াখানার বাউন্ডারী দেয়াল নির্মাণসহ পার্কটির সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। আশা করছি এই প্রস্তাবনাটি পাশ হলে ইকোপার্কের সৌন্দর্য্য আরো বৃদ্ধি পাবে। এদিকে, চলতি বছর (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সাল পর্যন্ত) ৩৩ লাখ ২৬ হাজার ৯শ ৪ টাকায় প্রধান গেইট, ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ওয়াচ টাওয়ার, ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬শ টাকায় ক্যান্টিনসহ মোট ৪৫ লাখ ৮১ হাজার ৫শ ৬ টাকায় ইজারা দেয়া হয়েছে। সরকার প্রতি বছর এ পার্ক থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৪৫ লাখ টাকার রাজস্ব আয় করলেও পার্কের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য কোন প্রকার অর্থ ব্যয় করছে না। তাছাড়া পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য ১টি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনসহ পার্কটির আরো পরিচ্ছন্ন ও নিরাপওাকর্মী রাখা জরুরী হয়ে পড়েছে বলে পার্ক কর্তৃপক্ষ জানান। এ সকল কাজগুলো সম্পন্ন করা হলে একদিকে পর্যটকরা আরো আনন্দিত হবে এবং সরকারের আরো রাজস্ব আয় বাড়বে।
এলাকাবাসীর সূত্রে, একই সাথে বর্তমানে কিছু সমস্যা মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিশেষ করে পিকনিক স্পটে আসা যাত্রীদের সাথে থাকা বিরামহীন সাউন্ড বক্স যা প্রচুর শব্দ দুষনের কারন। পার্কের ভিতর পানি সরবরাহের কোন ব্যবস্থা নেই। পান যোগ্য পানি পান করার নেই কোন টিউবওয়েল। তাই নিরুপায় হয়ে ভ্রমন পিয়াসুযাত্রী সাাধরনগন বাহির থেকে পানি কমপক্ষে ৬/৮শ টাকায় কিনে ব্যবহার করেন। আর এই পানি আনতে হয় বাহির থেকে। এই পানি সরবরাহ করে এলাকার পার্কের ভিতর আসা এলাকার মহিলারা। দূর হতে আসা পিকনিক পাটির গাড়িগুলোতে তারা এই পানি সরবরাহ করে জিম্মি করে রেখেছে তাদের। পার্ক গেইটের সামনে ও ভিতরে প্রচুর বালুধুলা। নেই ভাল মানের মোবাইল নেটওর্য়াক নেটওয়ার্ক এতই দুর্বল যে কোন মোবাইলেই সহজে কল ঢুকতে চায় না। প্রচুর রোদ বৃষ্টিতেও পার্কের ভিতরে নেই কোন সেড ঘর, পার্ক পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা করনে নেই কোন ব্যবস্থা। পার্কের ভিতরে বসেছে এলাপাথারী ভাবে শতশত দোকানপাট। এ ছাড়া সরকারী ভাবে একটি মাত্র ক্যান্টিন থাকলেও রয়েছে ছোট ছোট অনেক খাবারের দোকান। যা হিসাবের আওতায় আনা হয়নি বলে জানা গেছে।
পার্ক ও ইজারাদার কর্তৃপক্ষ রহমান ট্রেডার্সের প্রতিনিধি, শামিম, নজরুল, সাদ্দাম, ফারুক জানান, ইকোপার্কে ঢুকতে জনপ্রতি ১০ টাকায় টিকেট কাঁটার ব্যবস্থা রয়েছে। আর গাড়ী পার্কিং এর জন্য আলাদা আলাদা করে ফি নির্ধারন করা হয়েছে। এখানে ফি দিয়ে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠা, শিশু পার্কে প্রবেশের সুযোগও রয়েছে। শুধু দিনের বেলায় ব্যবহারের জন্য আছে ভ্যাটসহ (মৌসুমের সময়) ৬ হাজার ৯শ টাকার বিনিময়ে পাহাড়ের চূড়ায় চার কক্ষ বিশিষ্ট শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) সুসজ্জিত মহুয়া নামের রেষ্ট হাউজ। এ রেষ্ট হাউজ ব্যবহার করতে চাইলে মধুটিলা রেঞ্জ অফিস, ময়মনসিংহ অথবা শেরপুর বন বিভাগ অফিসে বুকিং দিতে হয়।
এ পার্কে ভ্রমন করতে আসা শেরপুরের তোফাজ্জল হোসেন রানা বলেন, পার্কটি এখন প্রায় অবহেলিত, পরিত্যক্ত। আমি এসে হতাশ হয়েছি, বন্ধুদের কাছে লজ্জা পেয়েছি। বাথরুম টয়লেটের বেহাল দশা। শুধু রেষ্ট হাউস ছাড়া প্রায় সবই বেহাল। তবে তিনি বলেন, এত সুন্দর জায়গাটি সরকার একটু নজর দিলেই আবার ভ্রমণ পিপাসু মানুষ আসতে শুরু করবে। প্রকৃতির অপরুপ দৃশ্য উপভোগ করতে পারবে।
সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান হাজী আজাদ মিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, শেরপুর-২ আসনের সাংসদ ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় পোড়াগাঁও ইউনিয়নে স্থানীয় বাসিন্দারের কর্মসংস্থানের লক্ষে ইকোপার্কটি স্থাপন করেন। আগে মাঝে মধ্যে দুই একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে থাকলেও এখন আর ওইসব ঘটনা ঘটছে না। তাছাড়া এপার্কে জীবন্ত প্রাণির জীববৈচিত্র ও বিভিন্ন প্রাণির সমাহার ঘটিয়ে যেভাবে সাজানোর কথা ছিল এখনও তার কিছুই হয়নি। কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টির অভাবে সম্ভাবনাময় ইকোপার্কটির সম্ভাবনা ম্লান হতে বসেছে। বিনোদন ও পাহাড়ী এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য পার্কটি বিশাল ভূমিকা রেখেছে। সম্ভাবনাময় এ পার্কটির প্রতি সরকারের জরুরী নজর দেয়া দরকার।
এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা একেএম রহুল আমীন সাংবাদিকদের বলেন, মধুটিলা ইকোপার্কটিকে পুর্ণাঙ্গ পার্কে পরিনত করতে এবং এর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। এজন্য আশপাশের এলাকায় শাল বাগান ও দীর্ঘ মেয়াদী বিলুপ্তপ্রায় গাছগাছালির বাগান করা সৃজন করা হবে। এছাড়াও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে লেক খনন ও পার্কের ভেতরের রাস্তার পাশে লাইটিং করা হবে। তবে তিনি এসব বিষয়ে স্থানীয়দের সহযোগিতা কামনা করেন।