ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকনে’র পরিবর্তে এবার দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে বেফাঁস মন্তব্য, মশা নিধনে ব্যর্থতা, নগরবাসীর আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়নি।
সাঈদ খোকনের দাবি, কর্তব্যে তিনি কখনও অবহেলা করেননি। দলীয় প্রধান যা ভালো মনে করেছেন তাই হয়েছে।
তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, মেয়র হিসেবে সাঈদ খোকন অনেক কাজ করেছেন। কিছু কাজ বাকি রয়েছে। তার আরও কাজ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু তার কিছু বেফাঁস কথাবার্তা তাকে সমালোচিত করেছে।
আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী সূত্র থেকে জানা যায়, মেয়র হিসেবে সাঈদ খোকন পুরো একটি টার্ম দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু ডেঙ্গু’র অবনতি ও কিছু বেফাঁস মন্তব্যের কারণে তিনি অনেকবার খবরের শিরোনাম হয়ে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন। দলের রাজনীতিতেও কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন তিনি, যা ক্ষমতাসীন দলের ইমেজ নষ্ট করেছে। তাছাড়া খোকন নগরবাসীর আশা-আকাক্ষা পূরণ করতে পারেননি। তাই তাকে বাদ দিয়ে ডিএসসিসির মেয়র পদে এবার নতুন প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর আজিমপুরের পার্ল হারবাল কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন স্থানে কর্মী সমাবেশ ডাকে আওয়ামী লীগ। তার পাশেই ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন পাল্টা কর্মসূচি দেন। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেওয়ায় কে বা কারা সমাবেশস্থলের সামনে ট্রাক ভর্তি করে সিটি করপোরেশনের ময়লা রেখে যায়। ওই ঘটনার জন্য মেয়র সাঈদ খোকনকেই দোষারোপ করা হয়। তখন তৎকালীন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ ও মেয়র খোকনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে দলীয়ভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন সাঈদ খোকন।
২০১৯ সালের ২৫ জুলাই রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে’র এক অনুষ্ঠানে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাকে ‘গুজব’ বলে অবহিত করেন মেয়র খোকন। তিনি বলেন, ‘মশা নিয়ে রাজনীতি কাম্য নয়। সাড়ে তিন লাখ আক্রান্তের যে তথ্য এসেছে সেটি কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিমূলক। ছেলে ধরা এবং সাড়ে তিন লাখ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত একই সূত্রে গাঁথা।’ মেয়রের এমন মন্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ দলের ভেতরে সমালোচনা ঝড় ওঠে।
গত শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জনপ্রিয়, গ্রহণযোগ্য এবং ভোটারদের কাছে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে, এমন প্রার্থীদের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দেওয়া হবে। বিতর্কের ঊর্ধ্বে যারা আছেন, যাদের কোনো অপকর্মের রেকর্ড নেই- তাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। আমাদের নেত্রীরও ইচ্ছে ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার।’ ধারণা করা হচ্ছে, নানা বিতর্কিত বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণেই ইমেজ সংকটে পড়া মেয়র খোকনকে দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে ফরম সংগ্রহ করার পর মেয়র সাঈদ খোকন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনাদের সুখে-দুঃখে যেভাবে ছিলাম, সেভাবেই যেন থাকতে পারি। কিছু কাজ বাকি আছে, সেগুলো যেন শেষ করতে পারি। আল্লাহকে হাজির নাজির রেখে বলছি, আমি কখনও কর্তব্যে অবহেলা করিনি। পিতার হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছি। আজ পিতা নেই। পিতার অবর্তমানে আমার অভিভাবক আমার নেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যা ভালো মনে করবেন, সেটাই করবেন।’
মেয়র খোকন নির্বাচনের পূর্বে ও পরে নগরবাসীকে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে ছিল- নাগরিকদের জন্য ফুটপাত উন্মুক্ত করে দেওয়া, বুড়িগঙ্গার স্বরূপ ফিরিয়ে আনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন, ডিজিটাল নগরী প্রতিস্থাপন, অগ্নিকা- প্রতিরোধ, মাঠ ও পার্ক উদ্ধার, বাস্তি উন্নয়ন ও যানজট মুক্ত ঢাকা গড়া। এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটাই পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। তবে প্রতিটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে অনেক দূর এগিয়েছেন বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
মেয়র খোকনের কর্মকাণ্ডের ব্যপারে জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশিষ্ট স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘সাঈদ খোকন কথাও বেশি বলেছেন কাজও অনেক করেছেন। কথা বলার সময় তার শব্দ চয়ন ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারেননি। যেটা তার কাল হয়েছে। এ কারণেও তিনি বাদ পড়তে পারেন। তিনি ঢাকার ৩১টি খেলার মাঠ উদ্ধার করে বিশ্বমানের করে দিয়েছেন। অন্ধকার থেকে ঢাকার সড়কগুলোকে আলোকিত করেছেন- যা কোনও মেয়র করতে পারেনি। আমি যদি পাল্লা দিয়ে মাপি তিনি অনেক কাজ করেছেন। তার যেসব ভুল ত্রুটি ছিল সেগুলোর জন্য শাস্তি দেওয়া যেতো। তবে তাকে অন্তত আরও এক টার্ম সময় দেওয়া যেতো। এই সময়ে তাকে সহযোগিতা করা উচিত ছিল।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘মেয়র খোকনের সামনে ভালো কাজ করার অনেক সুযোগ ছিল। তিনি চেষ্টাও করেছেন। পাঁচ বছর আগের পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিতি এক না। এখন ঢাকায় জনসংখ্যা বেড়েছে তাই সমস্যাও বেড়েছে। তবে তিনি এখতিয়ার বহির্ভূত কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যে কারণে তিনি তার সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তবে আগের চেয়ে ঢাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।’
উল্লেখ্য, সাঈদ খোকন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ হানিফের ছেলে। তিনি পুরান ঢাকার অন্যতম ব্যক্তিত্ব মাজেদ সর্দারের নাতি। বাবা মোহাম্মদ হানিফের হাত ধরেই সাঈদ খোকন রাজনীতিতে নামেন। তিনি আওয়ামী লীগে নাম লেখান ১৯৮৭ সালে ওয়ার্ড শাখার আইন বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে। ১৯৯৯ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০০৪ সালে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে মনোনিত হন। সর্বশেষ তিনি মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে ছিলেন। এরপর ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট পেয়ে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। ৬ মে তিনি মেয়র হিসেবে শপথ নেন।