পেশায় মেথর। ভাঙ্গড়িও কুড়িয়ে বেড়ান। ছোট জাতের মানুষ ভেবে সরকারী সকল সুযোগ বঞ্চিত মৃতঃ এন্তাজ আলীর ছেলে জানু(৩০)। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার কসবা ইউনিয়নের গোলাবাড়ী রেল স্টেশনের উজিরপুর গ্রামের দক্ষিণে খোলা আকাশের নীচে ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন দীর্ঘ ৮ বছর ধরে। সবার চোখের উপর বাস করলেও অসহায় দরিদ্র জানুর বসবাসের কোন ব্যবস্থা হয়নি। পশ্চিমে উঁচু পাহাড়ের মত রেল লাইনের ঢালুতে খোলা আকাশের নীচে পলেথিন মুড়ানো খুপড়ি ছোট্ট একটি ঘরে বসবাস ৫ সদস্য নিয়ে। ঘরের পূর্ব দিক দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। ঘরের চারেদিক ছেঁড়া লম্বা কাপড় দিয়ে ঘিরে প্রাচীর তৈরী করেছেন। প্রতিদিন ট্রেন আর পাকা রাস্তা দিয়ে প্রশাসনের কর্তা, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিসহ বিভিন্ন পেশাজীবির হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। প্রত্যেকের নজর কাড়ে খুপড়ি ঘরটি। সহায়তার পরিবর্তে দরিদ্র মানুষটির ঘর যেন সকলের তামাশার খোরাক। পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে জানুর খুপড়ি ঘরটিকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করে এক ঝলক হাসি দিয়ে পার হয়ে যায় প্রতিনিয়ত সবাই। কারো দয়া বা করুণা পড়ে না জানুর অসহায় পরিবারটির উপর। খবর পেয়ে জানুর পরিবারটি সত্যি কি এমন? ছুটে গেলাম তার খোঁজ নিতে, তার পলেথিন মোগড়ানো বাড়ীটি দেখতে। বেশী বেগ পেতে হয়নি জানুর খুপড়ি ঘর খুঁজতে। সবার কাছে দর্শনীয় এ ঘর যেন হাত ছানি দিয়ে ডেকে নিল। চারেদিক ছেঁড়া কাপড়ে মোড়ানো প্রাচীর। ছোট্ট খুপড়ি ঘর। সেদিন ছিল প্রচন্ড রোদ। তার ঘরের সামনে নাচোল নিউজের সম্পাদক ছোট ভাই সিপন আর আমি দাঁড়াতেই যেন পুড়ে যাচ্ছি। ডাক দিতেই জানুর স্ত্রী হারুনা(২৫) খুব সহজ-সরল ভাবে ছেঁড়া শাড়ি পরে খুপড়ি ঘর থেকে বের হয়ে বিনয়ের সাথে সালাম দিলেন। সাথে তার ২য় ছেলে ৬ বছরের মজিদুল। ছেলের পরনে কিছু ছিলো না(ল্যাংটা)। আমাদের বসতে দেয়ার জন্য খুপড়ি ঘর থেকে চেয়ার বা মোড়া খোঁজার চেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু সে সব থাকলে তো বের করবে? বারন করলাম কিছু লাগবে না। আমরা আপনাদের সাথে একটু কথা বলতে এসেছি। আমরা দু’জন তার খুপড়ির ভিতর মাথা নিচু করে বাঁকা হয়ে ঢুকে বসে পড়লাম। ভিতরে দেখতে পেলাম জানু ও তার ছোট ছেলে শান্তির ঘুমে ঘুমাচ্ছেন। তার স্ত্রীর সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলতে বলতে আধা ঘন্টা পার হলেও ঘুম ভাঙ্গে না জানুর। খুপড়ি ঘরের উপরে নেই কোন গাছের ছায়া প্রচন্ড রোদে আমাদের ঘাম ঝরছে। তারপরও জানুর যেন শান্তির ঘুম। একপর্যায়ে জানুর ঘুম ভাঙ্গলো। আমরা সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলছি তার ও তার স্ত্রীর সাথে। তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই সাদাসিধে হওয়ায় মানুষ তাদের ক্ষ্যাপা বলে। তাদের কথা শুনতে চাইলে জানু ও তার স্ত্রী হারুনা চোখের পানি অবিরাম গড়িয়ে যাচ্ছে চারটি চোখ দিয়ে। তাদের সাথে কি কথা হয়েছিল, সেটাই শুনি। দীর্ঘ ৮ বছর খোলা আকাশের নীচে বসবাস করছেন ৩ ছেলে হৃদয়(১২), মাজিদুল(৬) ও আব্দুল্লাহ(৪)সহ তারা স্বামী-স্ত্রীসহ মোট ৫জন। এর পূর্বে গোলাবাড়ী রেল স্টেশনে বসবাস করলে সেখান থেকে স্থানীয় লোকজন তাদের তাড়িয়ে দেয় ছোট জাত সুইপার/মেথর বলে। ঘরে চাল নেই টাকা-পয়সা কিছুই নেই। দ্বারে দ্বারে ঘুরে বাঁশ পলেথিন ভিক্ষা করে রেল লাইনের নীচে খোলা আকাশের নীচে খুপড়ি ছোট্ট ঘর তুলে বসবাস শুরু করেন। তারা বলেন, রাতে কিংবা দিনে যখন বৃষ্টি হয় তখন সবাই আরাম করে। আর তাদের ঘরের ভিতর দিয়ে গড়ে যায় বৃষ্টির পানি। সবাইকে খুপড়ির এক পাশে বসে রাত কিংবা দিন কাটাতে হয়। আর একনাগাড়ে বৃষ্টি হলে চুলা জ¦ালাতে পারে না। প্রচন্ড রোদে খোলা আকাশের নীচে কি হয় পাঠক আপনারা তো এমনিতেই বুঝেন। জানু বলেন, হয়তো সুখের মুখ দেখতে পাবেন আর কটাদিন পর। বড় ছেলে কাজে লাগবে আয় হবে সংসারে কিছুটা হলেও সুখ আসবে। কিন্তু ছেলে হৃদয় হঠাৎ ৩ বছর পূর্বে হারিয়ে যায়। ২/৩দিন বিভিন্ন স্থানে খোঁজা-খুঁজি করে তাকে পাওয়া যায়নি। টাকার অভাবে আর কোথাও খোঁজ-খবর নেয়া হয়নি। এর উপর আবার ঝাঁপটে পড়ে আরেক বাজ। নাচোল থানা পুলিশ তার কাছে এক পুরিয়া গাঁজা থাকার অভিযোগে জেল-হাজতে পাঠায় কোরবানি ঈদের ক’দিন পূর্বে। ঘায়ে ঘায়ে যেন ক্ষত কঠিন ক্যান্সারে রুপ নিলো। পুলিশের কিছু টাকার দাবী মেটাতে না পারায় জেল হাজতে যেতে হলো স্ত্রী ও ২ ছেলে রেখে। স্বামীকে মুক্ত করতে স্ত্রী হারুনা পাগল হয়ে ছুটেন দ্বারে দ্বারে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। এবার ঘরে থাকা বিক্রি উপযোগী জিনিসপত্র বিক্রি করে ফেলেন তিনি। আবারও ছেলে হৃদয়ের মত যাতে ২ ছেলের একজনও না হারিয়ে যায় এ ভয়ে ছোট ছোট ছেলেদের সাথে করে কোরবানি ঈদের দিন চলে যান চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে। ঈদের দিন এ বাড়ী ও বাড়ী গিয়ে কিছু গোস্ত সংগ্রহ করলেন স্ত্রী হারুনা। কিন্তু সেই ছোট ছেলেদের এক টুকরা গোস্ত রান্না করে খাওয়াতে পারলেন না। স্বামীকে জেল থেকে মুক্ত করতে টাকা লাগবে বিক্রি করে দিলেন ভিক্ষা করা সব গোস্ত। অবশেষে স্বামীকে জামিনে মুক্ত করলেন স্ত্রী হারুনা। কথা গুলো বলতে বলতে স্বামী-স্ত্রীর সারা শরীর চোখের পানিতে ভেসে গেলো। তারা দৌড় দিয়ে কসবা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলামের দেয়া একটি প্রত্যয়নপত্র ও স্বামী-স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র দেখালেন। তাদের জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের চেয়ারম্যান মেম্বার চাল দেয় না? সহজ-সরল উত্তর ঃ না। তারা না কি ছোট জাতের মানুষ। সে কারণে তাদের কিছুই দেয়া হয় না। জাতির পিতা মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি দেশের একটি মাত্র ছোট জাতের মানুষ জানু-হারুনা পরিবারকে বাদ রেখে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে ছিলেন ? না। তিনি দেখেননি, তাঁর সুযোগ্য মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বাদ রাখেননি। প্রধানমন্ত্রী দেশের কাউকে গৃহহীন ও দরিদ্র রাখবেন না। তারপরও জানু-হারুনার পরিবার যে ভাবে বঞ্চিত রয়েছেন দেশের সুবিধা থেকে এর জন্য দায়ি কে? এমন প্রশ্ন সচেতনমহলের। জানু- হারুনার অনেক শোনা গল্প থেকে পাঠককে বঞ্চিত করলাম। এবার খুপড়ি ঘর থেকে বের হয়ে সরকারী সুযোগ থেকে কেন বঞ্চিত জানু- হারুনার পরিবার জানতে সংশ্লিষ্ট কসবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলামের উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই কাকতালীয়ভাবে জানুর বাড়ীর সামনে রাস্তায় পেয়ে গেলাম তাকে। তিনি মোটরসাইকেল থেকে নেমে জানুর খুপড়িতে গেলেন। তার কাছে প্রশ্ন ছিলো প্রধানমন্ত্রী কাউকে গৃহহীন রাখবেন না এবং না খেয়ে থাকতে দিবেন না ঘোষনা থাকার পরও জানুর পরিবারের জন্য সরকারী সকল সুবিধা থেকে কেন বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি বললেন, তার জন্য একটি বাড়ী করার ব্যবস্থা করছি। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা হয়েছে। কিন্তু ৩ মাস পার হলেও কোন ব্যবস্থা হয়নি অসহায় পরিবারটির। চাল দেয়ার প্রশ্নে বলেন, চাল বিতরণের সময় তারা গেলে ৫/১০ কেজি চাল তাদের দিই। এদিকে নাচোল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবিহা সুলতানার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জানুর পরিবারের বাড়ী তৈরীর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তার বাড়ীর জন্য জমির কবিলিয়ত করা হয়েছে। তবে তার বাড়ী আগামী বছরে হবে বলে জানান।
এদিকে নাচোল উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল কাদেরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জানুর নিজের কোন জমি না থাকায় তার বাড়ীর ব্যাপারে সহযোগিতা করা যাচ্ছে না। সরকারী অন্যান্য সুযোগ বঞ্চিত বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানুকে খারাপ প্রকৃতির লোক বলে জানান। দরিদ্র জানু ও তার স্ত্রী হারুনা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে মাথা গুঁজার ঠাঁইসহ সরকারী সুযোগের দাবী জানান।