কিশোরগঞ্জের লোক শিল্পী ফিরোজ সাঁই মাতিয়ে রাখেন গ্রামীন সমাজ। পুঁথি জারি সারি কবিয়াল কিচ্ছা কাহিনি কবিতা ও গজল পরিবেশনা গ্রামীন জনগোষ্টীকে আনন্দ দিয়ে নিজেও আনন্দবোধ করে চলেছেন।
একটি জাতির আত্মপরিচয় তার লোকসংস্কৃতি। আর বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিই এ দেশের মূল সংস্কৃতির ভিত্তি৷ এখানকার সাহিত্য, জীবনবোধ, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনাচরণ লোকসংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামীণ সাধারণ মানুষের ভাষা, জীবনবোধ, বিনোদন, সাহিত্য, পেশা এসব নিয়েই গড়ে ওঠে ‘লোকসংস্কৃতি'৷ এই সংস্কৃতির মধ্যে থাকে সহজিয়া সুর। কোনো কৃত্রিমতা থাকে না লোকসংস্কৃতিতে। এটা সহজাত, সহজিয়া আর স্বাভাবিক বহতা নদীর মতো। পোশাকি সংস্কৃতির বিপরীতে এক শক্তিশালী সোঁদা মাটির গন্ধ ভরা স্বকীয় সংস্কৃতি। এর কোনো বিনাশ নাই। আছে আধুনিক সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার উদারতার ইতিহাস৷ তাছাড়া এই সংস্কৃতির ভাষাও লোকজ, যাকে বলা হয় লোকভাষা। সাধারণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মুখে, কথায়, ভাষার ব্যবহারে, লেখায় এর প্রকাশ পাওয়া যায়। অজপাড়ার এমন একজন লোকজ শিল্পীর নাম মোঃ ফিরুজ মিয়া ওরফে ফিরুজ সাঁই।
সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের গয়ালাপাড়া গ্রামে আবদুর রহমান ও জাবেদা খাতুনের পরিবারে ১৯৪০ সালের ২ এপ্রিল জন্ম গ্রহণ করেন। মহিনন্দ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। এর পরে আর কোন পড়াশোনা হয়নি তাঁর। প্রতিবেশী নয়াপাড়া গ্রামের আবদুল মজিদের আহবানে জনপ্রিয় বাংলা পালাগানের দল আলোমতিতে যোগদান করে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। আলো মতিদলের মাধ্যমে তিনি জেলার বাহিরেও বিভিন্ন পালাগানে ও মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন। সুন্দর গ্রামীন বাচন ভঙ্গি সরল মনের এই শিল্পীর জীবনটাও কেটেছে সাদাসিদে। জীবন জীববিকার তাগিদে ছুটে বেড়িয়েছেন জেলার অজানা অলিগলিতেও। ময়মনসিংহের নান্দাইলের মেরেংগার ফিরোজ ভুইয়ার বাড়িতে বহুবার,পাকুন্দিয়ার বাজারে,সদরের গালীমগাজি, রঘুখালী, জালারপুর বাজারে, করিমগঞ্জের সাতারপুরসহ বিভিন্ন স্থানে তৎকালে পালা গানের আসর জমজমাট করে রাখতেন। আলোরমতি সাংস্কৃতিক পালাদলের সংগঠনের সভাপতি ছিরেন মহিনন্দের তৎকালীন ইউপি সদস্য প্রয়াত আঃ মন্নান। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আঃ মজিদ ওরফে খুলশে মিয়া। প্রেম কুমারের ভূমিকায় ছিলেন গালিমগাজী গ্রামের জনৈক ব্যক্তি, জল্লাদ চরিত্রে ছিলেন শুকুমার দাস,পাহাড়ী চরিত্রে প্রয়াত শামসুদ্দিন, মন্ত্রীর চরিত্রে মন্নাছ মিয়া, সেনাপতির চরিত্রে কিশোরগঞ্জের নুর মাহমুদ, ছোট আলো ও বড় আলোর চরিত্রে চাঁন মিয়াসহ আরও অনেকেই।
সেময়ের আলো মতি পালা দলের পরিচালক ছিলেন করিম সরকার। তিনি বিভিন্ন চরিত্রের বাক্য পর্দার আড়ালে থেকে বলে দিতেন। করিম সরকার বলেন, এক সময়ে গ্রামে টিভি ভিসিআর ও মোবাইল ফোন ছিলো না। ফলে সাধারণ মানুষ পালাগানের আসরে সময় কাটাতেন। এখন সে সব আসর বিলুপ্তির পথে।
সাবেক ইউপি সদস্য আঃ রশিদ তোতা মিয়া বলেন, ফিরোজ মিয়া ওরফে ফিরোজ সাঁই সেই ছোটকাল থেকেই লোক মুখে কবিতা গজল গান কিচ্ছা কাহিনি শুনে শুনেই মুখস্ত করে ফেলতো। খুব মেধাবী অভিনেতা। তাঁর অভিনয় খুব ভালো লাগতো। লেখাপড়া না জানলেও তাঁর শ্রবন শক্তি প্রখর। সে একবার যা শুনে তা স্মরণে আছে আজও স্মৃতিতে।
বর্তমান ইউপি সদস্য মোঃ কামাল মিয়া বলেন, ফিরোজ সাঁই একজন প্রতিভাময়ী ব্যক্তি। তাঁর পালা গান ও কবিতা শুনে মানুষ এখনও মুগ্ধ হয়। সরকারীভাবে পৃষ্টপোষকতা পেলে সে আরও এগিয়ে যেতো।
শিক্ষাবিদ আলহাজ¦ মোঃ ইসরাঈল মিয়া বলেন, সাধারণভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসরত ‘অক্ষরজ্ঞানহীন' ও ঐতিহ্যের অনুসারী বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ‘লোক' বলে অভিহিত করা হয়। এই ধরনের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, সমাজব্যবস্থা, বিশ্বাস-সংস্কার ও প্রথা-প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংস্কৃতিতে মিল আছে। মার্কিন লোককলাবিদ স্টিথ থমসন এই লোক-মানসিকতার অভিন্ন গতি-প্রকৃতি দেখিয়েছেন তাঁর গবেষণায়। বাংলার কৃষক ফসল তোলার সময় এক গোছা ধান মাঠ থেকে এনে ঘরের চালে ঝুলিয়ে রাখেন। একে বলা হয় ‘লক্ষ্মীর ছড়া'। বিশ্বের নানা দেশের কৃষকসমাজেও একই প্রথা চালু আছে। কোথাও তা ‘শস্যরানি', কোথাও ‘শস্যপুতুল', কোথাও বা ‘শস্যমাতা' নামে অভিহিত। তাই লোকসংস্কৃতির একটা বিশ্বজনীন ও সর্বকালীন রূপ আছে। লাকজ শিলপী ফিরোজের পালা গানের উপস্থাপনা মনোমুগ্ধকর। সে আমাদের গর্ব আমাদের অহংকার।
মহিনন্দ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি আমিনুল হক সাদী বলেন, লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদানের রূপ-প্রকৃতির বিচার করে একে চারটি প্রধান ধারায় ভাগ করা হয়: বস্তুগত, মানসজাত, অনুষ্ঠানমূলক ও প্রদর্শনমূলক। সাধারণের জীবন ধর্মই হলো লোকসংস্কৃতি। আর বাংলাদেশে কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষকে কেন্দ্র করেই লোকসংস্কৃতির উদ্ভব। গ্রামীণ জীবনের একটি যাত্রাপালা সহজ এবং সাধারণ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটারই পোশাকি রূপ হলো নাটক। তাই সহজেই বলা যায় আধুনিক সংস্কৃতি তথা সাহিত্যের ভিত্তিই হলো লোকসংস্কৃতি বা লোকসাহিত্য। এ ক্ষেত্রে ফিরোজ মিয়া ওরফে ফিরোজ সাঁইয়ের অবদান বিরল। মঞ্চের অভিনয়ে কত যে জীবন বৈচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের বাঁকে বাঁকে। বয়সের ভারে এখনও নুইয়ে পড়লেও মনোবলে দূঢ় রয়েছেন। আমি তাঁর জীবনের উন্নতি ও সফলতা কামনা করি।
ফিরোজ মিয়া ওরফে ফিরোজ সাঁই বলেন,আমি কোন গল্পকার নই,কোন ইতিহাসবিদও নই। তবে প্রায় ৫০ বছরের আমার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অনেক স্মৃতি রয়েছে। কাউকে কোন উদ্দেশ্য করে আমার পালা গান কবিতা পরিবেশন করি নাই। কোন ধারনা ও আনুমানিকের উপর আমার পরিবেশনাও নহে। নেত্রকোনার কবিয়াল ফজলু মিয়ার লিখা কবিতা ও গানের খুব ভক্ত ছিলাম। তাঁর লিখা উচিত কথাসহ অনেক কবিতা শুনেই মুখস্থ করে ফেলতাম। নেশা ও সখের বশবর্তী হয়ে আলো মতি দলে জড়িয়ে ছিলাম। কত মানুষের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে আমাকে গীত পরিবেশনের জন্য নিতো। সেইসময়ে গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলো না। গভীর অন্ধকার রাত্রে হারিকেন ও লাইটের আলোয় চলে যেতাম ভক্তদের ডাকে। এখন অবশ্য বয়সের ভারে ও অসুস্থতাজনিত কারণে আর যেতে পারি না। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন।
দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত সাংসারিক জীবনে ফিরোজ মিয়া ২ মেয়ে ও ৩ ছেলের জনক। কবিয়াল ফিরোজ সাঁইয়ের সরকারী পৃষ্টপোষকতা পেলে বাকী জীবনে অন্তত একটু সুখে শান্তিতে বসবাস করে যাওয়ার আঁকুতি জানিয়েছেন।