রাজশাহীর তানোর উপজেলা ভূমি অফিসে দালালের দৌরাতেœ্য অসহায় হয়ে পড়েছেন এখানকার সাধারণ মানুষ। কিন্তু এ অবস্থায় উদাসীন রয়েছেন উপজেলা প্রশাসন। এনিয়ে তানোর পৌর এলাকার আমশো গ্রামের আজিজুল রহমান চলতি বছরের গত ২৫ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের অনুলিপি কপিতে অফিসের দায়িত্বরত কমচারি রিসিভ করে স্বাক্ষর দেন। কিন্তু অভিযোগের ১৭ দিন অতিবাহিত হলেও কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নেননি ইউএনও। ফলে বেপরোয়া দালাল ও ভূমি অফিসের কর্মরত জনবল। অপর দিকে তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরিন বানু’র সাথে স্থানীয় সাংবাদিকরা এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের ধুর মিয়া বলে দম্ভোক্তি করেন।
অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তানোর পৌর এলাকার জিওল গ্রামের ইয়াকুব হাজী প্রায় ৫ বছর ধরে তানোর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যাওয়া আসা করছেন। এখন তিনি অফিসে নিয়মিত বসছেন। তানোর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহসিলদার লুৎফর রহমান তাকে টেবিল চেয়ারে বসিয়ে কাজ করাচ্ছেন। কিন্তু ইয়াকুব হাজী সরকারি অফিসের নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী নন। এসুযোগে বর্তমানে তিনি অফিসের জমি-জমার রেকর্ডপত্র ও ফাইলপত্র ঘেঁটে প্রতিদিন মোটা অংকের টাকা কামাচ্ছেন।
এনিয়ে আমশো গ্রামের আজিজুল রহমান জানান, আমার অভিজ্ঞতার আলোকে ভূমি অফিসে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে ন্যায়নিষ্ঠা ও সততার সহিত উমেদার হিসেবে কাজ করেছি। যার প্রেক্ষিতে দুইজন সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজ্ঞতা সনদও প্রদান করেছেন। এ অবস্থায় চাকুরিতে প্রবেশের ৩০ বছর বয়স অতিক্রম করেছে। কিন্তু এত বছরেও আমার চাকুরি স্থায়ী হয়নি। ফলে মানবিক দিক বিবেচনা করে উপজেলা চেয়ারম্যান লুৎফর হায়দার রশিদ ময়ন ও স্থানীয় সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী মহোদয় আমাকে ভূমি অফিসের উমেদার হিসেবে থাকার সুপারিশ করেন। এরপরও ওই অফিসের নাজির (ভারপ্রাপ্ত) সাহিনুর রহমার আমাকে অফিসে বসে কাজ করার সুযোগ দেননি।
কিন্তু দালাল নামে পরিচিত ইয়াকুব হাজীকে কোনো সুপারিশ ছাড়াই অফিসে বসার জায়গা করে দিয়েছেন নাজির সাহিনুর রহমান ও তহসিলদার লুৎফর রহমান। এই ইয়াকুব হাজী মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন। মাদ্রাসার ছাত্র হয়েও চাকরি বাকরি না করে এখন তিনি দালালি ব্যবসা বেছে নিয়েছেন। এই ব্যবসা করে তিনি ওমরা হজ¦ও করেছেন। অনেক জমিজমাও কিনেছেন।
শুধু ইয়াকুব হাজী নয় তার মতো আরও অনেকে নামধারী দালাল রয়েছেন। এরা হলেন- উপজেলার গাগরন্দ গ্রামের নাজিম উদ্দিন, মুন্ডুমালা এলাকার সাজ্জাদ হোসেন, যশপুর গ্রামের মাসুদ রানা, বিল্লি গ্রামের আবদুল আলিম ও তানোর ঠাকুরপুকুর গ্রামের আরিফ ছাড়াও জেলার পবা উপজেলার পালোপাড়া গ্রামের কবির হোসেন।
এদিকে, তানোর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের পাশাপাশি মুন্ডুমালা ইউনিয়ন ভূমি অফিস, কামারগাঁ ইউনিয়ন ভূমি ও কলমা ইউপির দরগাডাঙ্গা হাটস্থ ইউনিয়ন সাব ভূমি অফিস ছাড়াও উপজেলা সদর ভূমি অফিসের কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারিরা বেপরোয়া। শুধু দালালরা নয়। অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
এনিয়ে দালাল নামে পরিচিত ইয়াকুব হাজী টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমি অফিসের কাজ জানি বলে স্যাররা আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন। আজিজুল হিস্যাক্ত মনোভাব নিয়ে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ করে লাভ নেই। আমার উপরে লোক আছে বলে দম্ভোক্তি করেন এই হাজী। এদিকে, আজিজুল রহমান এসব দালাদের অফিস থেকে অপসারণ করতে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ইউএনও বরাবর আবেদন দেন। কিন্তু আবেদন দেবার ১৭ দিন অতিবাহিত হলেও তাদেরকে অপসারণের জন্য কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি ইউএনও।
অপরদিকে, তানোর সহকারী কমিশনার (ভূমি) বদলির পর স্থবির হয়ে পড়েছে অফিসের স্বাভাবিক কাজকর্ম। ফলে প্রায় ৪ মাসে অন্তত তিন হাজার খারিজ ফাইল বন্দি হয়ে রয়েছে। পূর্বের পেনডিং ফাইল তো রয়েছেই। এতে করে এখানকার ভূমি সংক্রান্ত কাজকর্মে মারাতœক হয়রানি ও বিড়ম্বনায় পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
ভুক্তভোগিদের অভিযোগ, চলতি বছরের ১৩ জুন তানোর সহকারি কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ-আল-মামুন অন্যত্র বদলি হন। এরপর থেকে অনলাইন খারিজের নামে অফিসে চলছে হয়রানি ও প্রতারণা।
এঅবস্থায় কর্তৃপক্ষ, তানোর ভূমি অফিসে কাজকর্ম স্বাভাবিক রাখতে জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার এসিল্যান্ড ইমরানুল হককে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নিলেও সপ্তায় মাত্র ১ দিন অফিসে বসেন। তারপরও ঈদের ছুটির পর থেকে তানোর ভূমি অফিসে বসেননি তিনি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের কৃষক মাহাম্মাদ আলী জমি খারিজ বা নামজারির জন্য ভূমি অফিসে যান। সেখানে দালাল নামে পরিচিত ইয়াকুব হাজী তাকে দেখতে পেয়ে বলেন এভাবে খারিজ হবে না। আমাকে খারিজ খরচ বাবদ ৬ হাজার টাকা দেন। আপনাকে আশা লাগবে না। খারিজ করে পৌঁছে দেব। অথচ দেড় মাস ধরে ঘুরছেন ইয়াকুবের কাছে। তবুও কেস নাম্বার পাননি। কিন্তু তিনি বলেছেন গত আগস্ট মাসের ২৭ তারিখ তার জমি খারিজ হবার ফাইনাল ডেট ছিল। কিন্তু এসিল্যান্ড না থাকার কারণে খারিজ হয়নি। দেড়মাস ধরে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন তিনি। কবে নাগাদ তার জমি খারিজ হবে তাও বলতে পারছেন না অফিসের কেউ বলে আক্ষেপ করেন তিনি।
শুধু মাহাম্মদ নয়, তার মতো অনেক কৃষক জমি খারিজের জন্য মাসের পর মাস অফিসে ধর্ণা দিয়ে ঘুরছেন। বর্তমানে অফিসের জমা সহকারি জিয়াউল রহমান খারিজ ফাইল জমাও নিচ্ছেন না। তবে, তানোরে এসিল্যান্ড নিয়োগ করা হলে এই সমস্যা কিছুটা লাঘব হতে পারে বলে দাবি করেন এই কর্মচারি।
এব্যাপারে মোবাইল ফোনে এসিল্যান্ড ইমরানুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি মিটিং-এ আছি বলে মোবাইল সংযোগ বিছিন্ন করেন। পরে একাধিকবার ফোন করেও রিসিভ করেননি তিনি।
এব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরিন বানু’র সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার কাছে কোন অভিযোগ নেই। দালাল অফিসে বসে কাজ করছে নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করা হয়েছে এমন প্রশ্ন করলে তিনি দম্ভক্তির সুরে ধুর মিয়া বলে বলেন হাতে নাতে ধরে খবর দিয়েন ব্যাবস্থা নিবো, তাছাড়া এধরনের কথা বলবেন না। তিনি আরো বলেন, তানোর সহকারী কমিশনার ভুমি অফিসে কোন দালাল কাজ করেন না, ইউনিয়ন ভুমি অফিসে আউট সোর্চ হিসেবে কিছু কিছু লোক রাখা হয়েছে তাদেরকে দিয়ে কম্পিউটিার চালানোর জন্য। এসিল্যান্ড যোগদান করলে ব্যবস্থ্যা নিবেন বলেও জানান তিনি।