কিশোরগঞ্জে বিভিন্ন দুর্গাপূজায় অংশ নিয়ে নৃত্যে ও গানে ভক্তদেরকে মাতিয়েছেন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী শুক্লা সরকার। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কাররপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন এ শিল্পী রোববার জেলা সদরের বৌলাইয়ের পুঁথিপাড়ায় পূজার মহাঅষ্টমীতে আরতি নৃত্যে অংশ নেন। ভক্তদের অনুরোধে তিনি আরতি নৃত্যে অংশ নিলে ঢাকের তালে তালে নেচে ও গেয়ে তাদেরকে মাতিয়ে তোলেন। পরে তিনি পুজা ম-পের কল্যাণে নগদ ১০ হাজার টাকার অনুদান প্রদান করেন। এ সময় তার সাথে ছোট ভাই আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদ সুবল সরকারসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। পূজা উপলক্ষে সুবল সরকার দরিদ্রদের মাঝে বস্ত্র বিতরণ করেন।
অনুষ্ঠানে অন্যন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রতিদিনের জেলা প্রতিনিধি সাইফ উদ্দিন আহমেদ লেনিন, বৌলাই ইউপি চেয়ারম্যান আওলাদ হোসেন, ম-প কমিটির সভাপতি নিরঞ্জন সেন, সাধারণ সম্পাদক রিপন সাহা, সদস্য নিহার রঞ্জন সেন, সজল রায় ও মহিনন্দ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমিনুল হক সাদী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও তিনি সতাল পুজা মন্ডপে অংশ নেন।
শুক্লা সরকার ১৯৬১ সালের ১ মার্চ কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের গাংগাইল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সুশীল সরকার ও মাতা মালতি সরকার। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তিনি কিশোরগঞ্জের এস ভি সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
বাবার অনুপ্রেরণায় তিনি নাচ শুরু করেন। কিশোরগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমীর প্রখ্যাত নৃত্যগুরু নিকুঞ্জ বিহারী পাল এর কাছে তিনি নাচের তালিম নেন। উচ্চমাধ্যমিকপাশের পর ১৯৭৬ সালের ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে তিনি বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যান। তিনি গুরু যিতেন সিং ও আমোদ সিল এর কাছে মনিপুরী এবং হরিদাস নায়েরের কাছে কথাকলি নৃত্যের তালিম নিয়েছেন। পরবর্তীতে কলকাতার কলামন্ডালামে প্রখ্যাত নৃত্যগুরু থাঙ্কমনি কুট্রির তত্ত্বাবধানে ভরতনাট্যমে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
১৯৮৩ সালের মে মাসের শুক্লা সরকার বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। সাত মাস পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি স্বাধীনভাবে নৃত্য চর্চা শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে শুক্লা সরকার মহিলা সমিতি মিলনায়তনে প্রথম দর্শনীয় বিনিময় একক নৃত্যানুষ্ঠান আয়োজন করেন।
গুরু যিতেন সিং-এর পরিচালনায় তিনি চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করেন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর প্রযোজনা সোনাই মাধবসহ আরো অনেক নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করেন। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নৃত্যনাট্য এর মধ্যে রয়েছে শ্যামা,ভানুসিংহের পদাবলী, সামান্য ক্ষতি,পূজারিণী ও পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে। স্বামী স্বর্গীয় কমল সরকারের অনুপ্রেরণার ১৯৮৫ সালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি ভারতনাট্যম চর্চা শুরু করেন। শুদ্ধ শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা প্রবর্তন করেন।
শুক্লা সরকার বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত প্রথম সারির নৃত্যশিল্পী ও নৃত্য পরিচালক। শিল্পের প্রতি সৎ ও নিষ্ঠাবান,প্রচারবিমুখ এ শিল্পী বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার, কলকাতা যুব উৎসব সম্মাননা, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী পুরস্কার, বাংলাদেশ নৃত্য শিল্পী সংস্থা পুরস্কার, শেরেবাংলা পুরস্কার, মহিলা পরিষদ সম্মাননা, শান্তা- মারিয়ম আওয়ার্ড, সুরকুঞ্জ সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ভারত, মালয়েশিয়,জাপান, চীন, যুক্তরাজ্য, ইতালি, তুরস্ক সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।
তিনি বর্তমানে 'ধ্রুপদ কলা কেন্দ্র' নামে নাচের স্কুল পরিচালনা করছেন। ১৯৮৫ সালে প্রয়াত বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মো.মোরাদ আলী ও প্রয়াত কমল সরকারের বিশেষ অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের মেধা ও মননের বিকাশ এ শুক্লা সরকার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রয়াত কমল সরকারের সহধর্মিনী এবং দুই কন্যার জননী।
মহিনন্দ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমিনুল হক সাদী বলেন, আমাদের মহিনন্দের কৃতী সন্তান শুধু বাংলাদেশ নয় বহিবিশে^ নৃত্যকলায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দেহ তত্ত্ব ও নৃত্যে রয়েছে তাঁর অনেক ভূমিকা।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কাররপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শিল্পী শুক্লা সরকারের ভাই আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদ সুবল সরকার বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারো দুর্গাপূজা উপলক্ষে পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে তাঁর জন্মস্থান কিশোরগঞ্জে এসেছিলেন। বিভিন্ন দুর্গাপূজায় অংশ নিয়ে নৃত্যে ও গানে ভক্তদেরকে মাতিয়ে গেছেন।