চাকুরি যেন সোনার হরিণ। তবে প্রচলিত এ বাক্যে বর্তমান সময়ে যুক্ত হয়েছে স্বাচ্ছন্দ্যে ও স্বল্প সময়ের মধ্যে চলাচলের জন্য পরিবহনের বহুল কাঙ্খিত টিকিটের নাম। এ ক্ষেত্রে বিমানের কথা আসলেও বেশির ভাগই যাত্রীদের ভাবনায় এখন রয়েছে দ্রুতগতির ট্রেন। অধিকাংশরাই ট্রেনে ভ্রমনের প্রত্যাশা করলেও মিলছেনা কাঙ্খিত সেই টিকেট। আর শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত বগির টিকেটের ভাবনায় যুক্ত হয়েছে তদবীর বা দালাল। কারণ, কাউন্টারে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও এই শ্রেনির টিকেট প্রাপ্তির সংখ্যা অনেক কম। বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই রেলস্টেশনে হট্টোগোল হয়, এমন ঘটনায় টিকেট কালোবাজারি কারবারের দায়ে প্রশাসনের হাতে গ্রেফতারের ঘটনাও রয়েছে অনেক। চিত্রটি বিভাগীয় শহর রাজশাহী রেলস্টেশনের। কিন্তু সরকারি হিসাব মতে, মাস শেষে থেকে যাচ্ছে অনেক অবিক্রিত টিকেট।
জানা মতে, ঢাকা-রাজশাহী রুটে চলাচল করে এখন চারটি আন্তঃনগর ট্রেন। এই চারটি ট্রেনের এসি চেয়ার বা এসি বাথ/সিটের টিকিট সাধারণ যাত্রীদের কাছে যেন সোনার হরিণ। প্রতিদিন এই তিন শ্রেণির যে টিকিট বিক্রি হয়, তাতে কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে কয়জন টিকিট পান তা নিয়ে রয়েছে যাত্রীদের মাঝে নানা ক্ষোভ। ভিআইপি ও প্রভাবশালী ছাড়া সাধারণত টিকিট পৌঁছেনা এসব সাধারণ যাত্রীদের কাছে। ফলে ব্যাপক চাহিদার কারণে এই এসি টিকিট সবসময়জুড়ে থাকে ব্যাপক সঙ্কটে। কিন্তু মজার বিষয় হলো মাস শেষে যখন পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তার কাছে টিকিট বিক্রির হিসেব গিয়ে জমা পড়ছে, তখন এই এসি’র টিকিটই আসন সংখ্যার চেয়ে কম বিক্রি (অবিক্রিত) হচ্ছে বলে হিসাব দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, শোভন চেয়ারের টিকিট প্রতিমাসেই আসন সংখ্যার চেয়ে বেশি পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে বলেও হিসাব জমা পড়ছে। আশ্চর্যজনক হলেও এমনই ঘটনা পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের।
প্রাপ্ত তথ্যে, বিরতিহীন বনলতা ট্রেনের এসি’র চেয়েও অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি হচ্ছে। আর শোভন চেয়ার কম বিক্রি হচ্ছে বলেও নথিজাত করা হয়।
অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘এসির টিকিট অবিক্রিত তো পরের কথা, ততবির ছাড়া এ টিকিট মেলা দায়।’ তবে মাস শেষে জমা হওয়া পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের হিসাবে এসি’র টিকিটে কেন এই গড়মিল?
এমন প্রশ্নের উত্তরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ বলেন, ‘এসির সব টিকিট রাজশাহী স্টেশনের জন্য বরাদ্দ থাকে না। অনেক টিকিটই থাকে বঙ্গবন্ধু বা চাটমোহর স্টেশনের জন্য। আর এসির স্ট্যান্ডিং টিকিট সেল করা যায় না। ফলে সেখানে টিকিট অবিক্রিত থাকে। এ কারণে মাস শেষে অবিক্রিত টিকিটের হিসাবটা উঠে আসে।’
বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘সব ক্ষেত্রেই লাভ দেখলে হবে না। আগে দেখতে হবে যাত্রীসেবা। তারপরে ব্যবসা। এ কারণে ছাড় দিয়ে হলেও রেলসেবা দিতে হয়। এটি যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে।’
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সূত্র জানায়, রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন যে সিল্কসিটি আন্তঃনগর ট্রেনটি চলাচল করে সেটির আসন সংখ্যা ১৪৪টি। সে হিসাবে মাসে ২৬দিন চলাচল করলে আসন সংখ্যা বা টিকিট গিয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৮৭টি। কিন্তু নথিজাতকৃত সর্বশেষ তথ্যনুযায়ী গত জুন মাসে এই টিকিট বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৭১টি। একই ট্রেনের এসি চেয়ারের সংখ্যা রয়েছে ১৫৬টি। সেটি মাস শেষে আসন সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫৬টি। কিন্তু ৩ হাজার ২২ টি টিকিট বিক্রি হয়েছে বলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে হিসাব দেওয়া হয়।
আবার শোভন চেয়ারের সংখ্যা হলো প্রতিদিন একই ট্রেনে ৮৩০টি। যেটি মাস শেষে গিয়ে দাঁড়ায় ২১ হাজার ৫৮০টি। কিন্তু জুন মাসে ৩৮ হাজার ৫১৭টি টিকিট বিক্রি হয়েছে বলে হিসাব দেওয়া হয়। এসব টিকিট বিক্রি করে জুন মাসে আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ১১ লাখ ৯৩ হাজার ৫২৫ টাকা।
আবার সিল্কসিটি ঢাকা থেকে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ট্রেনে জুন মাসে এসি সিট/বাথের টিকিট বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৭১টি, এসি চেয়ারের ৩ হাজার ৮৫৪টি এবং শোভন চেয়ারের টিকিট বিক্রি হয়েছে ৩৪ হাজার ১৩৪টি। একই মাসে পদ্মা ট্রেনের এসি সিট/বাথের টিকিট বিক্রি দেখানো হয় ২ হাজার ৫৯২টি, এসি চেয়ার ২ হাজার ৮২৩টি এবং শোভন চেয়ার বিক্রি হয় ৩৩ হাজার ২২টি। ওই মাসে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া পদ্মা ট্রেনের এসি সিট/বাথের টিকিট বিক্রি দেখানো হয় ২ হাজার ১৫৩টি, এসি চেয়ার ৪ হাজার ৫৩৫টি এবং শোভন চেয়ার বিক্রি হয় ৩০ হাজার ৩৫৭টি।
অন্যদিকে বিরতিহীন বনলতা ট্রেনের জুন মাসে ৪ হাজার ১৬০ টি আসনের বিপরীতে টিকিট বিক্রি হয় ৪ হাজার ২৮৭টি। শুধুমাত্র এই ট্রেনের এসি টিকিটই বিক্রি বেশি দেখানো হয়েছে। এভাবে প্রতি মাসেই সিল্কসিটি, পদ্মা ও ধূমকেতু ট্রেনের বিপুল পরিমাণ এসির টিকিট অবিক্রিত থাকছে বলেও অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে একাধিক সূত্র জানায়, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অন্তত ২০ জন কর্মকর্তা থাকেন ঢাকায়। এসব কর্মকর্তা মাসে কমপক্ষে ৭-৮ বার বা তারও বেশি ঢাকায় যাতায়াত করেন। এই কর্মকর্তাদের জন্য এসি সিট/বাথ অথবা এসি চেয়ার টিকিট রাখতে হয়। ফলে বেশকিছু সংখ্যক টিকিট অবিক্রিত থেকে যায় প্রতি মাসে প্রতিটি ট্রেনেই।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজশাহী-ঢাকা রুটে সিল্কসিটি, পদ্মা ও ধূমকেতু ট্রেনের এসি টিকিট যেন সোনার হরিণ। কিন্তু সেই টিকিট মাস শেষে কিভাবে অবিক্রিত থাকছে, সেটি নিয়ে তদন্ত করতে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক কে (জিএম) একটি কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে কর্মকর্তাদের দাবি, রেলস্টাফদের চেয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের খামখেয়ালীপনায় মাস শেষে এসির টিকিট অবিক্রিত থাকছে। এসব নেতারা নিয়মিত যাতায়াতের কারণে সেসব এসির টিকিট অবিক্রিত দেখানো হয়, আবার ট্রেন ছাড়ার পূর্বমূহুর্তে অনেক সময়ই জানানো হয়, তাঁরা (নেতা বা আমলা) সেই ট্রেনে যেতে পারছেন না।’
সার্বিক বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জিএম হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘আমি যে কয়দিন আছি, সকল অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে যাবো। ট্রেনের যাত্রীসেবা নিয়ে কাউকে কোনো অনিয়ম করতে দেওয়া হবে না।