সংসারের শত অভাবের মধ্যদিয়েও কৃষাণী মোমেনা বেগম কষ্ট করে ১ টি গাভী পালন করছেন। গাভীটি গত ৮ মাস আগে ১ টি ষাড় বাছুর জন্ম দিয়েছিল। সন্তানের মত লালন পালন করে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তরতাজা ষাড় বাছুরটি সকলের নজর কেড়েছে। এই বাছুরটির মাধ্যমেই অভাব দূর করার স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। কিন্তু গত ৩ দিন আগে এর একটির পা ফুলে জ¦র এসে পরে সারা শরীরে বসন্তের মত গোল গোল চাক বের হয়েছে। এখন কোন কিছুই খাচ্ছে না। ফলে বাছুরটি ক্রমেই রোগাক্রান্ত ও দূর্বল হয়ে পড়েছে।
একই গ্রামের সুফিয়া বেগমও ২ টি দেশী জাতের গরু পালন করছেন। সংসারের টানাটানির মধ্যেও গরু দুটি বিক্রি করেননি। তার আশা ছিল আরও বড় করে বেশি দামে বিক্রির মাধ্যমে বেশি টাকা আয় করবেন। কিন্তু এত যতেœ পালিত একটি গরুর সপ্তাহ খানেক আগে দেখলেন পেটের উপরে গোল করে ফোসকা ওঠে গর্ত হয়ে পঁচন ধরেছে। যা দেখলে ভয় লাগছে। অনেক টাকার ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে কিন্তু ভালোর কোন লক্ষন নেই।
শুধু মোমেনা ও সুফিয়া একার নয়, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সব এলাকাতেই ছড়িয়ে পড়েছে গরুর এ রোগ। আক্রান্ত গরুগুলোর প্রথমে পা ফুলে যাচ্ছে। এরপর শরীরে জ¦র আসার ২/৩ দিন পরেই শরীরে বসন্তের মত গুটি গুটি ফোসকা বের হচ্ছে। স্থানীয় পশু চিকিৎসকেরা বলছেন, এটি এক জাতীয় মশার কামড়ে এ রোগের উৎপত্তি হচ্ছে। আক্রান্ত গরুগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় কৃষকেরা তাদের গোয়ালের গরুগুলো নিয়ে পড়েছেন মহাচিন্তায়। উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর বলছে এ রোগের নাম ( lumphy skin diseases)। তাদের ভাষায় এটি মরণ ব্যাধি নয়। এতে গোবাদি পশু দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে কিছুদিন চিকিৎসা দেয়া হলে সুস্থ হয়ে ওঠে। ভুক্তভোগী গরুর খামারীদের অভিযোগ এ উপজেলাতে ভেটেনারী সার্জন না থাকায় তাদের গোবাদি পশু চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে।
কালীগঞ্জ উপজেলার ১১ টি ইউনিয়নের সবগুলোতেই ছড়িয়ে পড়েছে। তবে পূর্বাঞ্চালের নিয়ামতপুর,মালিয়াট,জামাল ও কোলা ইউনিয়নে এর প্রাদুর্ভাবটা বেশি দেখা যাচ্ছে। বৃহস্পতি ও শুক্রবার সরেজমিনে এ এলাকাটিতে গেলে দেখা যায়, কৃষকদের গোয়ালের হালের বলদ, দুধের গাভী, সদ্যজাত বাছুর সব বয়সী গরুই এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত গরুগুলোর পা ফুলে গেছে এবং সারা শরীরের বসন্তের মত গুটি গুটি ফোসকা বের হয়েছে। আক্রান্ত গরুগুলো ঝিম ধরে রয়েছে। কোন কিছুই তেমন একটা খেতে চাচ্ছে না। এভাবে থেকে ক্রমেই শুকিয়ে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
উপজেলার পারখালকুলা গ্রামের মোফাজ্জেল হোসেনের ফ্রিজিয়ান জাতের একটি দুধের গাভীর পেছনের একটি পা ফুলেছে আর সারা শরীরে বসন্তের মত গুটি গুটি বের হয়েছে। একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে ওই গ্রামের ইমারত মন্ডলের ২ টি গরুর। শুধু এ গ্রামেই নয় উপজেলার ডাউটি গ্রামের লিখন তরফদারের ৩ টি চাষের বলদ, মনিরুল মিনের ১ টি, লতিফ মিনের ২ টি, মন্টু মিনের ১ টি, হরদেবপুর গ্রামের গোবিন্দ দাসের ৩ টি, স্বরজিৎ দাসের ২ টি, শরৎ দাসের ১ টি, বাগডাঙ্গা গ্রামের অরুন বিশ্বাসের ১ টি, সুভাষ নন্দির ১ টি, উল্ল্যা গ্রামের আরুজ বিশ্বাসের ২ টি, আছাদুজ্জামানের ২ টি, পীর আলীর ১ টি, কালু মিয়ার ১ টি, তালিয়ান গ্রামের বাদশা মিয়ার ১ টি, নারায়ন শীলের ৪ টি, ফায়জুল্লাহ হোসেনের ১ টি, পিকুল লাহেড়ীর ২ টি, কাবিলপুর গ্রামের শওকত আলীর ১ টি, লিকুর ১ টি, ইসতিয়াকের ১ টি, বাসুদেবপুর গ্রামের সিরু মিয়ার ১ টি, সাখাওয়াত হোসেনের ২ টি, নজরুল ইসলামের ১ টি, হুদা ডাউটি গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ২ টি, উপজেলার ৩ নং কোলা ইউনিয়নের বড় বায়সা গ্রামের সত্যেন বিশ্বাসের ২ টি, তপন বিশ্বাসের ২ টি, রনজিৎ বিশ্বাসের ৪ টি, সনজিৎ বিশ্বাসের ২ টি, আবদুস শহিদের ৩ টি, কবির হোসেনের ২ টি, আনার হোসেনের ২ টি, চুকাইতলা গ্রামের ক্ষিরোদ বিশ্বাসের ৩ টি, প্রকাশ বিশ্বাসের ২ টি, খেদাপাড়া গ্রামের তপন মজুমদারের ২ টি, সঞ্জিবন ঘোষের ২ টি, রামচন্দ্রপুর গ্রামের গোলাম নবীর ৩ টি, খালকুলা গ্রামের মনোরঞ্জন মন্ডলের ১ টি, দীনবন্ধু বিশ্বাসের ১ টি, অসিত বিশ্বাসের ২ টি, কার্তিক বিশ্বাসের ১ টি, মৃতুঞ্জয় বিশ্বাসের ১ টি, ময়ধরপুর গ্রামের নুর ইসলামের ১ টি, মিটুল বিশ্বাসের ১ টি, কোলা গ্রামের রবিউল শেখের ১ টি, স্বপন বিশ্বাসের ২ টি, গণেশ বিশ্বাসের ১ টি, কাদিরডাঙ্গা গ্রামের হরেন বিশ্বাসের ১ টি, চিত্ত সরকারের ১ টি, কামালহাট গ্রামের সত্যজিৎ বিশ্বাসের ৩ টি, দেবব্রত গাইনের ৩ টি, খড়িকাডাঙ্গা গ্রামের আতিয়ার রহমানের ১ টি, জাহিদুল ইসলামের ২ টি, দৌলতপুর গ্রামের মোদাচ্ছের হোসেনের ১ টিসহ অসংখ্য গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
উপজেলার ডাউটি গ্রামের কৃষক লিখন তরফদার জানান, তার হালচাষের ৩ টি বড় বলদের অবস্থা বেশ খারাপ। স্থানীয় চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন কিন্তু সুস্থ হচ্ছে না। উপজেলার তালিয়ান গ্রামের নারায়ন বিশ্বাস জানান, তার গোয়ালের মোট ৪ টি গরুর পা ফুলে গায়ে ফুসকা বের হয়েছে। তার একটি বড় বলদের অবস্থা খুবই খারাপ। পায়ের ফোলা স্থানে ক্ষত হয়ে পঁচন ধরেছে। ক্ষতস্থানটির মাংশ পঁচে গর্ত হয়ে গেছে। এ গরুটির জন্যই প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে কিন্তু এখনও সুস্থ হয়নি। উপজেলার ডাউটি গ্রামের কৃষক মনিরুর ইসলাম, খড়িকাডাঙ্গা গ্রামের আতিয়ার রহমান ও বড় বায়সা গ্রামের সত্যেন্দ্র বিশ্বাস বলেন, প্রতিটি কৃষক পরিবারেই গরু আছে। গোবাদিপশু তারা নিজেদের সন্তানের মত করে লালন পালন করেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে গেলে উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে গিয়ে মানসম্মত সেবা পাচ্ছেন না। কেননা এখানে কোন ভেটেনারী সার্জন নেই। শুনেছি উনি নাকি ঝিনাইদহে বসেন। গোবাদি পশু নিয়ে বাড়ি থেকে এত দুরের পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে যাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাদের দাবি সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষ অবশ্যই বিষয়টি দেখবেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ আতিকুজ্জামান জানান, এ রোগটি উপজেলার প্রায় সকল গ্রামেই কমবেশি দেখা দিয়েছে। রোগটির নাম lumphy skin diseases। তিনি বলেন,এটা হলে গোবাদি পশুর পা ফুলে শরীরে জ¦রসহ বসন্তের মত চাক চাক হয়ে ফোসকা উঠতে পারে। তবে এটা কোন ক্রমেই মরণব্যাধি নই। ফলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, তিনি খবর পেয়ে উপজেলার বেশ কিছু গ্রামে গিয়ে দেখেছেন। ব্যবস্থাপত্র দেয়া গোবাদি পশুগুলো ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। ভেটেনারী সার্জনের প্রশ্নে তিনি বলেন, এখানে পোষ্টিং হওয়া সার্জন ডেপুটেশনে বর্তমানে ঝিনাইদহ ভেটেনারী হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। যে কারণে একটু সমস্যা হলেও অফিসের অন্যন্যরা ম্যানেজ করে নিচ্ছেন। তবে আশা করছেন খুব শীঘ্রই এখানে ভেটেনারী সার্জন পাবেন।