ক্রয়ের চেয়েও প্রায় চারগুন জমি দখল করে নির্মিত হচ্ছে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তর। আর এই নির্মান কাজের জন্য ভেঙে ফেলা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ডাকবাংলোটিও। এসব সম্পত্তির মালিক রাজশাহী জেলা পরিষদ। বিষয়টি নিয়ে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে আরএমপি কমিশনার হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে দেখা করে প্রতিবাদ জানানো হলেও কাজ বন্ধ করা হয়নি। ফলে বিষয়টি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে অভিযোগের নিস্পত্তি হলেও কখনোই ফেরৎ পাবেনা ঐতিহ্যবাহী ডাকবাংলোর ভবনটি। যে ডাকবাংলোটির ইতিহাস পরবর্তি প্রজন্মরা জানলেও সেই ভবনের বাস্তব দৃশ্য আর কখনোই দেখতে পাবেনা। বিষয়টি নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হলেও তার বর্হিপ্রকাশ ঘটাতে পারছেনা।
কারণ জেলা পরিষদের ভাষ্য মতে, অপরাধকারী হচ্ছে এখানকার পুলিশ প্রশাসন। আর নগরবাসীর অভিযোগ, ঐতিহ্যবাহী ডাকবাংলো ভবনটি সংস্কার পূর্বক সংরক্ষণ না করে তা ভেঙে ফেলাতে কার ব্যক্তি স্বার্থ জড়িত ছিল এবং এখনও আছে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীর সিঅ্যান্ডবি মোড়ের প্রধান সড়কের পার্শের এই ৫ দশমিক ৯৫ একর জমি নিয়ে ছিলো জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। এর মধ্যে জমির পশ্চিম দিক থেকে ১ দশমিক ৩৯ একর রাজশাহী মহানগর পুলিশের কাছে বিক্রি করে জেলা পরিষদ। আর পূর্বের অংশের ডাকবাংলো ভাড়া নিয়ে চলছিল আরএমপি সদর দপ্তরের কার্যক্রম। কিন্তু এখন পুরো জমিটিই দখল করে নিয়ে তৈরী করা হচ্ছে আরএমপির সদর দপ্তর। এতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন উপকৃত হলেও প্রকৃতপক্ষে কার ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল হচ্ছে সে প্রশ্নের জবাব নগরবাসী জানলেও তার প্রকাশ ঘটাতে পারছেনা।
এর আগে ঐতিহ্যবাহী ডাকবাংলোটি ভাঙায় গত ৬ মে রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকারের নের্তৃত্বে একটি দল আরএমপি কমিশনার হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে দেখা করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে কাজ বন্ধ করা হয়নি। ফলে বিষয়টি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গড়িয়েছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে গত ২২ আগস্ট আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে সভা থেকে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার নূর-উর-রহমানকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে মন্ত্রণালয়ের গঠিত এ কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে মাপজোখ করে জমির সীমানা নির্ধারণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রাপ্ত সূত্রে জানা গেছে, ওই সভায় অন্যান্যের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব আজীজ হায়দার ভুঁইয়া, স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইফফাত আরা মাহমুদ ও আরিফুল ইসলাম খান, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শাহাব উদ্দীন, উপ-মহাপরিদর্শক আবু হাসান মাহমুদ, রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার, আরএমপি কমিশনার হুমায়ুন কবীর, স্থানীয় সরকার বিভাগের রাজশাহীর পরিচালক শ্যাম কিশোর রায়, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আহসান হাবিব, রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পারভেজ রায়হান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীর সিঅ্যান্ডবি মোড়ে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোটি পুলিশ ভাড়ায় ব্যবহার করতো। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ভাড়া পরিশোধ করে আরএমপি। পরবর্তীতে আর ভাড়া প্রদান করেন নি।
সূত্র মতে, ৫ দশমিক ৯৫ একর জমি থেকে ১ দশমিক ৩৯ একর জমি কেনার পর বাকি জমিটুকুও বিক্রির জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে জেলা পরিষদের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সে সময় জেলা পরিষদে নির্বাচিত চেয়ারম্যান না থাকার কারণে জমি বিক্রি করা যায়নি। তবে ওই সময় জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নির্বাচিত চেয়ারম্যান আসার পর বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা হবে।
পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আসলেও তারা পুলিশের কাছে জমি বিক্রি করেন নি বলে দাবি করা হচ্ছে। জেলা পরিষদের ভাষ্য মতে, অবৈধভাবে জেলা পরিষদের জমি দখল করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আরএমপির স্থায়ী সদর দপ্তর নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে। এর আগে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে জেলা পরিষদের জায়গা দখল করে ডাকবাংলোর সামনে প্রধান ফটক নির্মাণের কাজ শুরু করে আরএমপি। তখনও জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হলেও তার কোন কর্নপাত করেন নি আরএমপি।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, বিক্রিকৃত ১ দশমিক ৩৯ একর জমির সীমানা ২০০৮ সালের ৭ জুলাই আরএমপির কাছে বুঝিয়ে দেয় জেলা পরিষদ। তখন সীমানা পিলারও স্থাপন করা হয়েছিল। এই বিক্রি করা জমির মধ্যে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর পাঁচ শতাংশ পড়েছিল। কিন্তু ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পর ভাড়া প্রদান না করেই পুলিশ পুরো ডাকবাংলোটি অবৈধভাবে দখল করে নেয়। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ডাকবাংলোটি ভাঙতে শুরু করে। এ নিয়ে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদপূর্বক ভাঙাকাজটি বন্ধের জন্য আরএমপিকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি ও ১৮ মার্চ দুটি চিঠি দেওয়া হয়। তারপরেও ডাকবাংলো ভাঙা বন্ধ না করে পুরো জমিটিই দখলে নিয়ে আরএমপির সদর দপ্তর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে শেষ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হলে গত ২২ আগস্ট আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার রোববার সন্ধ্যায় মুঠোফোনের মাধ্যমে প্রতিবেদককে বলেন, ‘চিঠিতে কাজ না হওয়ায় আমরা স্বশরীরে আরএমপি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে নির্মাণ কাজ বন্ধের অনুরোধ করেছি। তখন তিনি বলেছিলেন, রাজশাহীতে নতুন এসেছেন, জমির বিষয়ে কিছুই জানেন না। খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টির সমাধান করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাধান হয়নি। তবে এখন জমির সীমানা নির্ধারণে একটি কমিটি হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই উদ্ভুত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোববার সন্ধ্যায় মুঠোফোনের মাধ্যমে এই প্রতিবেদককে বিপিএম ও পিপিএম পদকপ্রাপ্ত রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ডাকবাংলোটি ভাঙার কারণে কোন নগরবাসী অভিযোগ করেছে তাকে আমার সামনে নিয়ে আসেন, একটু দেখি।’ এরপর জেলা পরিষদের অভিযোগ মতে তাদের বিক্রির চেয়েও চারগুন জমি অবৈধভাবে দখল করে আরএমপি সদর দপ্তর নির্মাণ করা হচ্ছে অভিযোগটির সত্যতা জানতে চাইলে প্রতিবেদককে আবারও অভিযোগকারী সেই নগরবাসীকে তাঁর সামনে হাজির করার কথা উল্লেখ করে আরএমপি কমিশনার বলেন, ‘যেহেতু নগরবাসীর পিতা মেয়র, সেহেতু তার সাথে এ বিষয়ে কথা বললেই জানতে পারবেন।’ তাহলে জেলা পরিষদের অভিযোগ সত্য নয় এমনটিই দাবি করছেন; কি না উত্তরে পুলিশ কমিশনার মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আপনী পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করে কি আমার জমিতে বিল্ডিং করবেন? এটাই বোঝেন, এতোটুকু বুঝলেই হবে।