দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের তথা গোটা বরিশালের মানুষের স্বপ্নের রেলপথে যোগাযোগ স্থাপন প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। রেলপথ নির্মান কাজ শুরু হওয়ার আগে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ প্রকল্প পরিকল্পনার আওতায় বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি ভূমি অধিগ্রহনে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থদের সাথে মতবিনিময় করেছেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো। সভায় ক্ষতিগ্রস্তদের নানান সুবিধা-অসুবিধার কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
সূত্রমতে, ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা পর্যন্ত ২১১ দশমিক পাঁচ কিলোমিটার রেলপথের দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিডিসি) হয়ে ডেভেলপমেন্ট এ্যান্ড সেফ গার্ড কনসালট্যান্টি (ডিএসসি) মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সার্ভে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পর্যায়ক্রমে চলমান সকল সার্ভে যাচাই-বাছাই করে রেলপথের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে। এরপরই শুরু হবে রেলপথ অবকাঠামো নির্মানের কার্যক্রম।
পরামর্শক এসব প্রতিষ্ঠানের সূত্রে জানা গেছে, ভাঙ্গা-পায়রা রেল লাইন প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ২১১ দশমিক পাঁচ কিলোমিটার ধরা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সিঙ্গেল লেনের রেললাইন নির্মানের কথা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহন এমনভাবে করা হচ্ছে যাতে ভবিষ্যতে দুটি লেন করা হলেও নতুন করে ভূমি অধিগ্রহনের প্রয়োজন হবে না। এ কারনে ২১১ দশমিক পাঁচ কিলোমিটার রেললাইন প্রসস্থে একশ’ মিটার বা ৩২৮ফিট হবে। আর গোটা রেলপথের জন্য ভাঙ্গায় একটি জংশন নির্মান করা হবে। পাশাপাশি টেকেরহাট, মাদারীপুর, বরিশালের গৌরনদী, দেহেরগতি (এয়ারপোর্ট), বরিশাল সদর (কাশিপুর), বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালী, আমতলী, পায়রা পোর্ট, পায়রা এয়ারপোর্ট ও কুয়াকাটায় মোট ১১টি স্টেশন নির্মান করা হবে। তবে এর বাহিরে সাব স্টেশনও থাকতে পারে।
অপরদিকে নদী ও খাল বেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চলে রেলপথকে সংযুক্ত করতে বড় ধরনের আটটি ব্রিজসহ কয়েকশ’ ছোট ও মাঝারি আকারের ব্রিজ-কালর্ভাট নির্মান করা হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিএসসি’র সুপারভাইজার মোঃ সরোয়ার জাহান পার্থ জানান, ভাঙ্গা থেকে পায়রা পর্যন্ত রেলপথের ম্যাপ ও জায়গা নির্ধারন করা হয়েছে। তবে কুয়াকাটার স্টেশনের ম্যাপ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তিনি বলেন, দুইবছরের চুক্তিতে দীর্ঘ নয় মাস পূর্বে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। তবে আমরা ফিল্ড পর্যায়ে কাজ শুরু করেছি গত ২৫ মে থেকে। বর্তমানে আমরা মাঠপর্যায়ে ভূমি অধিগ্রহনে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থদের সাথে মতবিনিময় করছি। তাদের বিভিন্ন কথা শুনছি এবং ভূমি অধিগ্রহনের বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের পদক্ষেপগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরার কাজ করছি।
ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের পরামর্শক আহসান এলাহী জাহির জানান, ভূমি অধিগ্রনের সময়ে যেন কোন সমস্যার সৃষ্টি না হয় সে জন্য ক্ষতিগ্রস্থদের মানসিক পরিবর্তনে সভা অব্যাহত রয়েছে। এতে করে ভূমি অধিগ্রহন নিয়ে মানুষের মনে থাকা দ্বিধাদন্ধ কেটে যাবে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কালকিনির পাঙ্গাসিয়া থেকে বরিশালের দপদপিয়া পর্যন্ত একশ’ কিলোমিটার রেলপথের জরিপে প্রায় তিন হাজার ১৫০টি অবকাঠামো পাওয়া গেছে। যারমধ্যে ব্যক্তি মালিকানার পাশাপাশি কমিউনিটি প্রোপার্টিও রয়েছে। আর গোটা প্রকল্পের সংখ্যা সাত হাজারের কাছাকাছি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের জেষ্ঠ্য পরামর্শক আকতারুল ইসলাম খান বলেন, পুরো রেল লাইনের মধ্যে যে সকল মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান এবং শশ্মানসহ কমিউনিটি প্রোপার্টি থাকবে সেগুলো সরকারই স্থানান্তরিত করে দিবে। এর বাহিরে অধিগ্রহনকৃত জমির ব্যক্তি মালিকানার কাগজপত্র ঠিক থাকলে কোন দপ্তরই অর্থ আটকিয়ে রাখতে পারবেনা। তাই সকলের উচিত হবে জমির কাগজপত্র পুরোপুরি ঠিক করে রাখা। ভূমি অধিগ্রহন আইন অনুযায়ী সকল মালিককে তার পাওনা পরিশোধ করা হবে সঠিকভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন জড়িপ সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের সকল মানুষই রেলপথ নির্মানের পক্ষে মত দিয়েছেন। সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে কিছু প্রশ্ন থাকলেও সবাই ভূমি ছাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আর সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থরা তাদের প্রশ্নে কৃষি-অকৃষি জমি এবং বসতভিটা জমির মূল্য নির্ধারন, মাছের খামার, গাছ, গবাদি পশুর খামার, পারিবারিক জমি বন্টন, জমি রেকর্ডের ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতা, অর্থ গ্রহনের সময়ে বিভিন্ন বাণিজ্যসহ নানান বিষয় জানতে চেয়েছে। নগরীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম ইছাকাঠি এলাকার বাসিন্দা ও ভূমি অধিগ্রহনে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্থ মাইনুল ইসলাম বলেন, বাপ-দাদার ভিটে মাটি মিলিয়ে প্রায় এক একর সম্পত্তি রেলপথের জন্য দিয়ে দিতে হবে, রাজিও আছি। কারণ আমি চাই বরিশালে রেল যোগাযোগ চালু হোক। তিনি বলেন, এতোদিন শঙ্কায় ছিলাম কি হবে কিন্তু যখন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মতবিনিময় করেছে, তখন সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন কেউ আর আমাদের বোকা বানাতে পারবে না। সরকারের এ উদ্যোগ সত্যিকারের কাজে আসবে।
জিয়াউল হক নামের একই এলাকার অপর এক বাসিন্দা বলেন, স্বাভাবিক কারনে সরকারের পক্ষ থেকে ভূমি অধিগ্রহনের কথা শুনলেই মানুষের মনের মধ্যে নেতিবাচক একটা ধারনা জন্মায়। তবে মতবিনিময় সভায় সেই নেতিবাচক ধারনা পাল্টে ইতিবাচক হয়ে গেছে।
অপরদিকে কালিকিনির একটি কলেজ, শেখ হাসিনা সেনানিবাস ও পায়রা বন্দর এলাকার জন্য রেলপথের নকশায় কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি ঐতিহ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে বরিশালের রেলওয়ে স্টেশনের নকশা করা হয়েছে ইলিশের মতো করে।