২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে দলের সভাপতি (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে নৃশংস ও বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা কেড়ে নিয়েছিলো ২৪ জন নেতাকর্মীর প্রাণ। তাদেরই একজন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সহসম্পাদক বরিশালের মুলাদী উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের রামারপোল গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাক আহমেদ সেন্টু।
আকস্মিকভাবে গ্রেনেড হামলা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই মঞ্চের সামনে দর্শক সাড়িতে বসা সেন্টু প্রিয় নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) রক্ষা করতে একলাফে মঞ্চে উঠে অন্যান্যের সাথে নেত্রীকে জড়িয়ে রাখেন। ফলে গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে তিনি (সেন্টু) মারা যায়। এখনও বিচার পাওয়ার আশায় স্বজন হারানোর দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন নিহত সেন্টুর পরিবার। তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্থিক সহযোগিতা চাননা, তারা নিহতের পরিবারকে সঠিক মূল্যায়নের পাশাপাশি নৃশংস ওই হামলায় জড়িত সকল অপরাধীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার দাবি করেছেন।
চার বছর বয়সে বাবাকে হারানো মোস্তাক আহমেদ সেন্টুর একমাত্র কন্যা আফসানার কাছে তার বাবার কথা জানতে চাওয়া খুব সহজ ছিলোনা, তারপরের যা পাওয়া গেলো তা শুধুই চোখের জল। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত বাবার ¯েœহ-ভালোবাসা ছাড়া বড় হয়ে ওঠা আফসানাকে নিয়েই এখন মোস্তাক আহমেদ সেন্টুর স্ত্রী আইরিন সুলতানা বেবির জীবনযাপন। বিবাহ বার্ষিকীর একদিন আগে স্বামীকে হারানো বেবির স্মৃতিতে আজো সব কিছুই দগদগে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত মোস্তাক আহমেদ সেন্টুর স্ত্রী আইরিন সুলতানা বেবি জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের তো কিছুই চাওয়ার নেই। আপা (শেখ হাসিনা) যদি বছরে একবার হলেও বলেন-তোমাদের কোন চিন্তা নেই, আমি তোমাদের পাশে আছি। এতোটুকু শান্তনাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। এর বেশি আর আমাদের কিছুই চাওয়ার নেই।
পাশাপাশি দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়ানো নিহত মোস্তাক আহমেদ সেন্টুর পরিবারের সদস্যরা চান নৃশংস ওই হামলায় জড়িত সকল অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা। তারা মনে করেন, এতে ফিরে পাওয়া যাবে না তাদের হারানো স্বজনকে কিন্তু এ ধরনের নৃশংস হামলার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো সম্ভব হবে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে শহীদ মোস্তাক আহমেদ সেন্টুর বিধবা স্ত্রী বলেন, বিগত বছরগুলোতে ২১ আগস্ট স্মরণ সভায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দাওয়াত পেয়ে আমি ও আমার একমাত্র কন্যা আফসানা আহম্মেদ রিদি, বৃদ্ধ শাশুড়ি মনোয়ারা বেগমসহ পরিবারের সদস্যরা স্মরণসভায় গিয়ে বসার জায়গা পাইনি। শোকাহত পরিবারদের বসার নির্ধারিত জায়গার চেয়ার আগে থেকেই নেতারা দখল করে বসে থাকেন। আমাদের বসার ব্যবস্থা পর্যন্ত কেউ করে দেয়না। তাই আমরা গত কয়েক বছর ধরে স্মরণসভায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তিনি (বেবী) অনুষ্ঠানে বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে শোকাহত পরিবারগুলোর সদস্যরা যেন সাক্ষাত করতে পারেন সে ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি জোরদাবী করেছেন।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিহতের নিজ এলাকা মুলাদী উপজেলার রামারপোল শহীদ মোস্তাক আহমেদ সেন্টু স্মৃতি সংঘের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং সেন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগি রাজিব হোসেন ভূঁইয়া রাজু জনকণ্ঠকে বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে চলাকালীন সময় মোস্তাক আহম্মেদ সেন্টু ভাইয়ের সাথে আমি মঞ্চের সামনে দর্শক সাড়িতে বসে নেত্রীর দিকনির্দেশনামূলক ভাষন শুনছিলাম। আকস্মিকভাবে গ্রেনেড হামলা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই সেন্টু ভাই প্রিয় নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) রক্ষা করতে এক লাফে মঞ্চে উঠে অন্যান্যের সাথে নেত্রীকে জড়িয়ে রাখেন। একপর্যায়ে আমি (রাজু) দৌঁড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ঘটনাস্থল থেকে গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত সেন্টু ভাইকে উদ্ধার করে মুমূর্ষ অবস্থায় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের নিয়ে যাই। সেখানে বসে শরীর থেকে গ্রেনেডের স্প্রীন্টার বের করতে সেন্টু ভাইকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। অপারেশন চলাকালীন সময় ওইদিন রাত সাড়ে নয়টার দিকে সেন্টু ভাই মারা যায়। এর একমাস পর তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল সেন্টু ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী বেবীকে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই সেন্টু ভাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে কখনোই তিনি নিজের কথা ভাবেননি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেম, মাটি ও মানুষের সাথে গভীর মমতার ছাঁপছিলো তার মাঝে। সেন্টু ভাই ছিলেন এতদাঞ্চলের মাটি ও মানুষের নেতা। দলমত নির্বিশেষে এলাকার সর্বস্তরের জনগণের হৃদয়ে ছিলো তার অবস্থান। খুব অল্পসময়ই তিনি মানুষকে ভালবেসে আপন করে নিতেন। তার অনুপস্থিতি আজ মুলাদীকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।
সূত্রমতে, প্রতিবছর গ্রেনেড হামলাকারীদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে মুলাদীর রামারপোল গ্রামে শহীদ সেন্টু স্মৃতি সংঘের উদ্যোগে ২১ আগস্ট স্মরণসভা ও দোয়া-মোনাজাতের আয়োজন করা হয়। এবছরও অনুরূপ কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে।
বরিশালের মুলাদী উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের রামারপোল গ্রামের মৃত আফছার উদ্দিন হাওলাদারের সাত পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে গ্রেনেড হামলায় নিহত মোস্তাক আহম্মেদ সেন্টু ছিলেন ষষ্ট। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতের পর সেন্টুর লাশ রামারপোল গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সূত্রমতে, মোস্তাক আহম্মেদ সেন্টু বরিশাল জেলা স্কুল থেকে এসএসসি ও বিএম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে শহীদুল্লাহ্ হলে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে সেন্টু মাস্টার্স পাস করেন। ১৯৯৬ সালে মুলাদী উপজেলার রামারপোল এএম উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক মোঃ আবুল হাসানাত মৃধার কন্যা আইরিন সুলতানা বেবীকে সামাজিকভাবে বিয়ে করেন সেন্টু। দাম্পত্য জীবনে তিনি (সেন্টু) ছিলেন এক কন্যা সন্তানের জনক।
মুলাদী উপজেলার আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, জীবদ্দশায় মোস্তাক আহমেদ সেন্টু স্বপ্ন দেখেছিলেন বরিশাল-৩ আসনের উন্নয়ন ও সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে। ২১ আগস্ট বিরোধী পক্ষের গ্রেনেড হামলায় মোস্তাক আহমেদ সেন্টুর সব স্বপ্ন তছনছ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মুলাদী, হিজলা ও বাবুগঞ্জ উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ছিলো স্থবিরতা। আওয়ামী লীগের কোন সভা, সমাবেশ ও মিছিল রাজনৈতিক কর্মসূচি ওইসব উপজেলায় ছিলোনা। ঠিক সেই মুহুর্তে মোস্তাক আহমেদ সেন্টু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবকাঠামোকে জোরদার করতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে ওই তিন উপজেলাসহ পাশ্ববর্তী গৌরনদী উপজেলার আওয়ামী লীগকেও উজ্জীবিত করেন।
ফলশ্রুতিতে বেশ স্বল্প সময়ে সর্বত্র মোস্তাক আহমেদ সেন্টুর কয়েক হাজার ভক্ত বের হয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সাহসী নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে মোস্তাক আহমেদ সেন্টু। ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বাচাঁতে গিয়ে শহীদ হন মোস্তাক আহমেদ সেন্টু। এরপর থেকেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুন্যতা দেখা দেয় বরিশাল-৩ সংসদীয় এলাকায়। পরবর্তীতে সেন্টু শুন্য বরিশাল-৩ আসনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক হাল ধরেন মোস্তাক আহমেদ সেন্টুর বড় ভাই জাপান প্রবাসী মোস্তাফিজুর রহমান নিলু। মোস্তাফিজুর রহমান নিলু ২০০৪ সাল থেকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। ফলশ্রুতিতে মোস্তাফিজুর রহমান নিলু মুলাদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
এছাড়াও মোস্তাফিজুর রহমান নিলু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ প্রজন্মলীগের প্রতিষ্ঠা সভাপতি। তিনি (নিলু) জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনীতি করতে গিয়ে ভাইকে হারিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক মাঠে আছি এবং থাকবো। কিছু পাওয়ার আশায় নয়; জনগনের সুখে-দুঃখে পাশে থাকতে রাজনীতি করি। যতোদিন বেঁচে আছি শহীদ মোস্তাক আহমেদ সেন্টুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাবো।